এবনে গোলাম সামাদ – ফাহমিদ-উর-রহমান

এবনে গোলাম সামাদের ভাবনাচিন্তার উপর এই আলোচনাটি প্রথম দু-পর্বে প্রকাশিত হয় ২৪ জুলাই ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকায়। লিখেছেন বিশিষ্ট চিন্তক এবং সুলেখক ফাহমিদ-উর-রহমান।


এক.

প্রাচীনকালের পণ্ডিত ব্যক্তিদের দেখা যায় তারা একই সাথে বহু বিষয়ে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তারা হলেন বহুপ্রজ। তাদের মন ছিল সৃষ্টিশীল এবং ছিল বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহ ও অধিকার। দেখা গেল, কেউ একজন পেশায় চিকিৎসক, পাশাপাশি তিনি আবার ধর্মতত্ত্ববিদ ও দার্শনিক। কেউ জ্যোতির্বিজ্ঞানী, অথচ কাব্য চর্চাও করেন।

জ্ঞান জগতের অসাধারণ বিস্তৃতির ফলে বিশেষজ্ঞতার ক্যাটাগরি নির্মাণ করতে হয়েছে। কিন্তু সৃষ্টিশীল মানুষ এই ক্যাটগরিতে অনেক সময় আবদ্ধ থাকতে চান না। তারা এই ক্যাটাগরির সীমা অতিক্রম করে যান। এবনে গোলাম সামাদ এ রকম একজন পণ্ডিত যিনি প্রাচীনকালের বহুপ্রজ পণ্ডিতদের সিলসিলা বহন করছেন।

পেশাগতভাবে তিনি একজন উদ্ভিদবিদ্যাবিদ। কিন্তু এই বিষয়ের বাইরে তিনি বিশেষভাবে আগ্রহশীল হন নৃতত্ত্ব ও শিল্পকলার দিকে। এ বিষয়ে তিনি অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রচুর অধ্যয়ন ও অনুশীলন করেছেন। এই অনুশীলনের ফল হিসেবে তিনি বাংলাদেশে প্রথম নৃতত্ত্ব ও শিল্পকলার উপরে তত্ত্বীয় আলোচনা করেন ও পুস্তকাদি রচনা করেন। এদিক দিয়ে তাকে বলা যায় বাংলাদেশের প্রথম নৃতাত্ত্বিক ও শিল্প সমালোচক। এটির পাশাপাশি তিনি ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ, ধর্ম ও রাজনীতি নিয়েও বিস্তর লেখালেখি করেছেন। সেই হিসেবে তিনি একজন বিদগ্ধ সমাজবিজ্ঞানীও বটে। বাঙালি মুসলমান সমাজ ও জনগোষ্ঠীকে বোঝার ক্ষেত্রে সামাদ টুলস হিসেবে ব্যবহার করেছেন তার নৃতত্ত্ব ও শিল্পকলা বিষয়ক অধীত জ্ঞানকে। এই টুলস ব্যবহার করে তিনি দেখাতে চেয়েছেন, বাঙালি মুসলমান ইতিহাসের ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়ে একটি জাতিতে পরিণত হয়েছে এবং নিজেদের একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে।

ঠিক একই টুলস ব্যবহার করে ধর্মেরও তিনি আলোচনা করেছেন। নৃতত্ত্বে ধর্ম নিয়ে বিশেষ গুরুত্বের সাথে আলোচনা করা হয়েছে। মানুষের ইতিহাসে ধর্মচিন্তার উদ্ভব হয়েছে রাষ্ট্রচিন্তার আগে। ধর্মচিন্তার ভেতর দিয়ে আইন কানুনের ধারণা এসেছে, যা রাষ্ট্রচিন্তাকে প্রভাবিত করেছে। রাষ্ট্রচিন্তা বুঝতে হলে তাই ধর্ম বাদ দিয়ে সম্ভব নয়।

সামাদ ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু ১৯৭১-এর ঘটনাবলি তার মনে বিপুল ভাবান্তর সৃষ্টি করে। তিনি কলকাতা গিয়ে বুঝতে পারেন মুক্তিযুদ্ধ বলতে ভারত যা বুঝায়, বাংলাদেশের মানুষ তা বুঝায়নি। ভারত চেয়েছিল স্রেফ পাকিস্তান ভাঙতে। আর বাংলাদেশের মানুষ চেয়েছে একটি পৃথক রাষ্ট্র গড়তে। তার এই বোঝাবুঝি তাকে উপমহাদেশের ইতিহাস অনুশীলন করতে প্রাণিত করে এবং এই পৃথক রাষ্ট্র উদ্ভবের স্বরূপ নির্ণয়ে তিনি তাত্ত্বিক আলোচনা করেন। একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে এটা সামাদের একটা বড় বৈশিষ্ট্য।

দুই.

এবনে গোলাম সামাদের পৈতৃক বসতভিটা ছিল সাবেক যশোর জেলার মাগুরা মহকুমায়। মাগুরা এখন জেলা। বাবার রেলের চাকরির সূত্রে তারা রাজশাহী শহরে নিবিষ্ট হন এবং এই শহরেই সামাদের জন্ম ২৯ ডিসেম্বর ১৯২৯। ছয় ভাইবোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ সামাদের পিতার নাম মৌলভী মোহাম্মদ ইয়াসিন ও মাতার নাম নসিরন নেসা। সামাদের বড়বোন দৌলতুন নেসা খাতুন বৈবাহিক সূত্রে রংপুরে নিবিষ্ট হওয়ার পর তিনি সেকালের বিখ্যাত নেতা আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। দৌলতুন নেসা খাতুন পরবর্তীকালে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের টিকিটে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হন। ব্যক্তিগতভাবে দৌলতুন নেসা একজন সুসাহিত্যিক ছিলেন।

সামাদের লেখাপড়ার হাতেখড়ি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে। তবে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার ব্যাপটিস্ট মিশনারি স্কুল থেকে ১৯৪৮ সালে। উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন ১৯৫০ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে।

রাজশাহী শহরেই সামাদ বেড়ে উঠেছেন। বলা চলে এই শহর তাকে নির্মাণ করেছে। রাজশাহী শহরের কাছেই সাঁওতালদের গ্রাম। ছোটবেলা থেকেই তিনি দেখেছেন শহরে সাঁওতালদের আনাগোনা। যা তার কিশোর মনের ঔৎসুক্য বাড়িয়ে দেয়। তিনি সাঁওতালদের সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু করেন। এই পড়াশুনাই তাকে পরবর্তীকালে নৃতত্ত্বের ওপর উচ্চতর পড়াশোনা করতে আগ্রহী করে তোলে। বাংলা ভাষার অনেক সাহিত্যিকই সাঁওতাল জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। সাঁওতালদের অভিজ্ঞতা অনেককে শিল্পী বানালেও সামাদকে বানিয়েছে নৃতাত্ত্বিক। পরবর্তীকালে সামাদ যখন উচ্চশিক্ষার জন্য ফ্রান্সের পারীতে যান, তখন সেখানকার নৃতত্ত্ব জাদুঘর তার জ্ঞানের জগতকে অনেক বাড়িয়ে দেয় এবং তার নৃতাত্ত্বিক হওয়ার স্বপ্ন পূরণের পথ খুলে দেয়।

১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন তেজগাঁও এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট থেকে সামাদ কৃষি গ্রাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন। সেই হিসেবে তিনি একজন কৃষিবিদও। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলাত যান এবং সেখানকার লিডস বিশ^বিদ্যালয় থেকে প্লান্ট প্যাথলজি বিষয়ে পোস্টগ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা লাভ করেন ১৯৫৫ সালে। সামাদ লিখেছেন :

তার বাবা একটি বাড়ি বিক্রয় করে যে টাকা পান তা দিয়ে তাকে পাঠান বিলাতে। তার সেখানে আরো পড়বার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি অর্থের অভাবে। দেশে ফিরে তিনি ঢাকায় পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে চাকরি করেন চার বছর। চাকরির পাশাপাশি শেখেন ফরাসি ভাষা। ১৯৬০ সালে ফরাসি সরকারের একটি বৃত্তি নিয়ে ফ্রান্সে যান এবং সেখানকার পোয়াতিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জীবাণুতত্ত্বে পিএইচডি করেন। দেশে ফিরে ১৯৬৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন। তিনি একটানা বত্রিশ বছর উদ্ভিদ বিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু তার এই পেশাগত অধ্যাপনার জন্য তিনি যতটুকু পরিচিতি পেয়েছেন তার চেয়ে তিনি বেশি সমাদৃত হয়েছেন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি আত্মমুখী হলেও তার চিন্তাচর্চার সাথে জনসম্পৃক্তির কখনো অভাব ঘটেনি। বিশেষ করে তার চিন্তাচর্চা চলমান স্রোতের সাথে ভেসে না গিয়ে স্রোতের প্রতিকূলে সুবর্ণ হয়ে ওঠে। বুদ্ধিজীবীতার ক্ষেত্রে এটা সামাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক।

ছেলেবেলায় তিনি চিত্রকর হতে চেয়েছিলেন। রংতুলি হাতে নেয়ারও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সামাদের অনেক স্বপ্নের মতো সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কিন্তু চারুকলার প্রতি তার প্রীতি কখনো নিঃশেষ হয়েও যায়নি। সামাদ লিখেছেন :

মানুষ তার চারুতার সাধনায় ফুল, লতাপাতা নিয়ে নকশা রচনা করেছে। উদ্ভিদ জগৎ মানুষের চিত্রকলায় জুড়েছে অনেক স্থান। হতে পারে এটাও আমাকে অনেক পরিমাণে উদ্ভিদ জগতের প্রতি আকৃষ্ট করেছে।

হয়তো এ কারণেই তিনি হতে পেরেছেন বাংলাদেশের প্রথম শিল্প বোদ্ধা। সামাদের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছেন সুইডিশ নিসর্গবিদ কার্লফন লিনে। লিনে ছিলেন চিকিৎসক। কিন্তু তিনি বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন উদ্ভিদ, প্রাণী ও আকরিক বস্তুর শ্রেণীবদ্ধ আলোচনা করার জন্য। মানুষকে তিনি গাত্রবর্ণ দিয়ে ভাগ করেছেন। সে হিসেবে তিনি ছিলেন একজন নৃতাত্ত্বিক। পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন লোক সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ। তার ছিল নানা বিষয়ে কৌতূহল। সামাদের ভেতরেও কাজ করেছে বিচিত্র বিষয়ে কৌতূহল। এই কৌতূহল তিনি লিনে থেকেই পেয়েছেন।

তিন.

নৃতাত্ত্বিক হিসেবে এবনে গোলাম সামাদের স্বাতন্ত্র্য বা প্রাসঙ্গিকতা কি অথবা তার নৃতাত্ত্বিক জ্ঞান আমাদের ইতিহাস পর্যালোচনায় কিভাবে কাজে আসতে পারে? নৃতত্ত্ব বিষয়ে তার বইটির নামও নৃতত্ত্ব; যা প্রথম লেখা হয় ১৯৬৭ সালে। তারপর থেকে নৃতত্ত্ব বিষয়ক জ্ঞানের বিভিন্ন পর্যালোচনা হয়েছে এবং এই পর্যালোচনায় বিভিন্ন টুলস ব্যবহার করা হয়েছে। আর পাঁচটা আধুনিক জ্ঞানের মতো নৃবিজ্ঞানের জন্ম হয়েছে পশ্চিম দেশে। এই কারণে এসব আলোচনায় পশ্চিমকেন্দ্রিক পক্ষপাত এড়ানো সম্ভব হয়নি। আজকাল মুসলিম জগতে এ কারণে পশ্চিমকেন্দ্রিক নৃবিজ্ঞানকে পর্যালোচনার প্রশ্ন উঠেছে। পশ্চিমা কাঠামোর মধ্যে নৃতত্ত্বে জাতীয়তাকে অলঙ্ঘনীয় হিসেবে ধরে সবকিছুর মূল্যায়ন করা হয়। এই চিন্তা অনেক ক্ষেত্রে জাতি বিদ্বেষের জন্ম দেয়। জাতিত্বের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য, কিন্তু জাতি বিদ্বেষ নিন্দনীয়। মুসলিম পণ্ডিতরা বলছেন জাতিত্ব নয়, উম্মাতের চেতনায় নৃবিজ্ঞানকে যাচাই করা চাই। এবনে গোলাম সামাদ পশ্চিমা টুলস ব্যবহার করেই এই বইটা লিখেছেন। কিন্তু তার বিশেষত্ব হচ্ছে তিনি নিজের অধীত নৃতাত্ত্বিক জ্ঞানকে পরবর্তীকালে বাঙালি মুসলমানের স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিতকরণে ব্যবহার করেছেন। এই স্বাতন্ত্র্য চেতনাকে আমাদের এখানকার সেকুলার পণ্ডিতরা সাধারণত গ্রহণ করতে চান না। নৃতত্ত্বে জাতি গঠনে ভাষার মতোই ধর্মের গুরুত্ব সমধিক। সেকুলার পণ্ডিতরা ভাষার কথা বললেও ধর্মের কথা বাদ দিতে চান। কিন্তু সামাদ মনে করেন ইসলাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এ দেশের জাতিসত্ত্বায়। ইসলামকে বলা চলে এ দেশের জাতি গঠনের Ethno-formative factor।

এবনে গোলাম সামাদ নৃতাত্ত্বিক আলোচনায় কোনো রকম মতবাদিক গোড়ামির প্রশ্রয় দেননি। মার্কস প্রভাবিত নৃতাত্ত্বিকরা একটা সমাজের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের ওপর জোর দেন। ম্যাক্স ভেবর সমাজ বিশ্লেষণে সমাজের নিয়মনীতি, ধ্যান-ধারণার বৈশিষ্ট্যের কথা বলেন। দুরকেইম সমাজকে বুঝতে চেয়েছেন সমাজের নিজস্ব নিয়ম নীতির সাহায্যে। সামাদ নৃতত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মানুষের অর্থনৈতিক ও তার ভাবনা-ধারণার জগৎ সবকিছু মিলিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছেন।

নৃতাত্ত্বিকভাবে বাংলার মানুষ মঙ্গল-দ্রাবিড়, এই ছিল স্যার হার্বাট রিজলের মত। কিন্তু খন্দকার ফজলে রাব্বি এই মত অস্বীকার করে বলেছিলেন, বাংলার মুসলমানরা প্রধানত বাইরে থেকে এসেছে। তুর্কিরা এসেছিল স্থলপথে। আর আরবরা এসেছিল সমুদ্রপথে। এ কথা সত্য, বহুপ্রকার মানবধারার সংমিশ্রণ ঘটেছে বাঙালি মুসলমানের ভেতরে। তবে জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার যে আর্য থিওরির কথা বলেছেন, সে হিসেবে বাঙালি মুসলমান আর্য নয়। তারা অনার্য। এটাই সামাদের মত। এখনো ভারতে যে রাজনীতি চলছে তা এই আর্য থিওরির ওপর প্রতিষ্ঠিত, যার ভিত্তি হচ্ছে হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থ বেদ। বাঙালি মুসলমান ঐতিহাসিকভাবে এই আর্য ও আর্যাবর্তের রাজনীতির বাইরে অবস্থান করেছে।

বাংলা ভাষাকে আর্য পরিবারভুক্ত ভাষা হিসেবে উল্লেখ করেছেন ভাষাতাত্ত্বিক আব্রাহাম গ্রিয়ারসন। কিন্তু সামাদ বলেছেন, এই ভাষায় দ্রাবিড় পরিবারভুক্ত ভাষার প্রভাবও আছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন বঙ্গ নামটা কোনো আর্য পরিবারভুক্ত ভাষা নয়। এটা এসেছে চীনা পরিবারভুক্ত ভাষা থেকে। শুধু তাই নয় বঙ্গ বলতে একসময় বুঝাত পূর্ববঙ্গকে, পশ্চিমবঙ্গকে বলা হতো রাঢ়।

বাঙালি মুসলমানের ভাষার মধ্যেও আছে এক ধরনের স্বাতন্ত্র্য। এই ভাষাকে এক সময় মুসলমানী বাংলা বলা হতো। সামাদ রেভারেন্ড উইলিয়াম গোল্ডসেকের মুসলমানী বাংলার অভিধানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, এখানে যেসব শব্দ সঙ্কলিত হয়েছে, এগুলো সবসময় মুসলমান সমাজে চলেছে। হিন্দু সমাজে এসব শব্দ ছিল অজানা। সামাদের এই চিন্তার সাথে আবুল মনসুর আহমদের ভাষা চিন্তার যথেষ্ট মিল আছে।

সামাদ বলতে চান, নরগোষ্ঠীগতভাবে বাঙালি মুসলমান হচ্ছে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি। আরবি ভাষার পরেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলমান কথা বলেন বাংলাভাষায়। সামাদের তাই মত :

বাংলাদেশ টিকে থাকলে তাই একদিন বাংলাভাষাকে বিশ্বে মুসলমানের ভাষা হিসেবে গণ্য করা হবে : হিন্দুর ভাষা হিসেবে আর নয়। বাংলা ভাষাকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব এখন পড়েছে বাংলাদেশের মানুষেরই ওপর। কারণ বাংলাদেশের ওপর নির্ভর করছে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ।

সামাদ আর একটা জিনিস দেখাচ্ছেন এ দেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে প্রমাণ করার জন্য বাঙালি মুসলমানের মধ্যে যেসব প্রাক ইসলামী বা অনৈসলামী ভাবধারা টিকে আছে তার ওপর জোর দেয়া হয়। এর দ্বারা তারা প্রমাণ করতে চান বাঙালি মুসলমানের বৈশিষ্ট্য বা বাঙালিত্বের বুনিয়াদ। এই বৈশিষ্ট্যকে তারা বলেন Syncretistic tradition-সমন্বয়বাদী ঐতিহ্য। এর ফলে বাঙালি মুসলমানের জীবনে ইসলামের যে একটা প্রভাব আছে তা আলোচ্যসূচি থেকে বাদ পড়ে যেতে থাকে। মনে হতে থাকে বাঙালি মুসলমান যেন মুসলমানই নয়।

সব দেশেই লোক সংস্কৃতি থাকে এবং থাকে এক উচ্চস্তরের সংস্কৃতি। এই লোক সংস্কৃতির সাথে ইসলামের মূল বিশ্বাসের অনেক সময় মিল থাকে না। এখানে বিশেষ করে মনে রাখতে হবে, লোক-বিশ্বাসের ওপর মুসলিম সমাজ চলে না। মুসলিম সমাজ চলে কুরআন-হাদিসের নির্দেশনায়। বিশ্বের সর্বত্রই ইসলাম মুসলমানদের একটা জীবনযাপনের রীতি নির্দেশ করেছে। বাঙালি জাতিবাদীরা তাদের তত্ত্বায়নের জন্য প্রচার করেন বাংলাদেশে যে ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল তা হলো সূফীবাদী ইসলাম, শরিয়তি ইসলাম নয়। এর সাথে খাঁটি ইসলামের সংযোগ খুব কম। এর সাথে মিশ্রিত হয়েছিল সনাতন যোগ সাধনার। এই ভাবধারা প্রথম প্রচার করেন হিন্দু মহাসভার প্রতি সহানুভূতিশীল পণ্ডিত সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। এ দেশের বাঙালি জাতিবাদীরা সুনীতির কাছ থেকেই তাদের তত্ত্ব ধার করেছেন বলে মনে হয়।

একটা জিনিস জানা দরকার বাংলার মুসলমান মোটের ওপর তার সমাজ জীবনে কুরআন-হাদিসের নিয়ম কানুনকে মেনে চলতে চেয়েছেন চিরকাল। অন্য দিকে সূফীবাদের সাথে সনাতন ধর্মের সাধনায় কোথাও কোথাও মিশ্রণ ঘটলেও সেটা ইসলামী সূফীবাদের প্রধান ধারা নয়। মুসলমান সূফীরা সাধারণত সংসার ধর্ম করেছেন। অন্যান্য ধর্মের মরমিবাদীরা অবিবাহিত থাকতে চেয়েছেন। মুসলিম সূফিরা সাধারণত জীবনবিমুখ নয়। প্রয়োজনে তারা জেহাদ করেছেন। যেমন শাহজালাল, শাহ মখদুম, খান জাহান আলী, বাবা আদম শাহ শহীদ।

বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ বিজয়ের পর থেকে এ দেশে বিস্তর কুরআন-হাদিসের চর্চা হয়েছে। গড়ে উঠেছে মাদরাসা। এসব মাদরাসায় ফিকাহর চর্চা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে মানুষ হজে গেছেন। ফেরার সময় তারা নিয়ে এসেছেন মুসলিম বিশ্বের নানা অংশের চিন্তার ফসল। তাই কেবল লোক-ইসলাম ও তথাকথিত সূফী সাধনার মাধ্যমে বাংলার মুসলিম মানস ব্যাখ্যা করা যায় না। এ কথা ঠিক পীরপূজার একটা অনুপ্রবেশ ঘটেছে বাঙালি মুসলমানের মধ্যে। কিন্তু সেটা শুধু বাংলাদেশের ঘটনা নয়। পুরো মুসলিম জগতেই এটা ঘটেছে। এই প্রভাব থেকে মুক্ত করার জন্য চেষ্টাও হয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আবদুল ওহাব এই পীরপূজার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন। এর প্রভাব বাংলাদেশে এসেও পড়েছে। এটি ধর্ম-সংস্কার আন্দোলনের মধ্যেই সীমিত থাকেনি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবি আদায়ের আন্দোলনেও পরিণত হয়েছে। ওহাবী, ফরায়েজী ও তিতুমীরের মোহাম্মদীয়া আন্দোলন এর বড় প্রমাণ। সামাদ লিখেছেন :

বাংলাদেশ আজ একটা পৃথক রাষ্ট্র। বাঙালি মুসলমানকে নিয়ে নতুন করে আলোচনা তাই স্বাভাবিক। কিন্তু আজকের বাঙালি মুসলমানকে বুঝে দেখতে হলে যা স্বীকার করা দরকার, তা হলো বাঙালি মুসলমানের আছে একটা স্বতন্ত্র ইতিহাস। বাংলাদেশের মুসলমানের মধ্যে কাজ করে চলেছে যে ধর্ম চেতনা, তা কেবল বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, তার ব্যাপ্তি বিশ্বের একটা বিরাট অংশজুড়ে। অতীতে ইসলামী বিশে^র এক অংশের জাগরণ আর এক অংশকে প্রভাবিত করেছে। বাঙালি মুসলমানও ইসলামী বিশে^র মূলভাবনা স্রোত থেকে বিছিন্ন হয়ে থাকেনি, থাকতে পারেনি। কেবল বাংলাদেশের মধ্যেই থাকেনি তার দৃষ্টি সীমাবদ্ধ হয়ে।

চার.

শিল্পকলা নিয়ে এবনে গোলাম সামাদ তিনটি বই লিখেছেন :

শিল্পকলার ইতিকথা (১৯৬০)
ইসলামী শিল্পকলা (১৯৭৮)
মানুষ ও তার শিল্পকলা (২০০৬)

শিল্পকলা নিয়ে সামাদের আগ্রহ ও বুদ্ধিবৃত্তির গভীরতার ফল হচ্ছে এ বইগুলো। এসব লেখালেখির ভেতর দিয়ে সামাদ যেমন শিল্পকলা বিষয়ে বাংলাভাষী পাঠকদের আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন তেমনি শিল্পকলার ভেতর দিয়ে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের জায়গাটাও চিহ্নিত করেছেন।

শিল্পের মাধ্যমে আমরা মানব মনের আশা-আকাক্সক্ষার কথা পড়তে পারি। শিল্প আসলে মানুষের জীবনের অংশ। ধর্ম যেমন মানুষের সমস্যা-বিক্ষুব্ধ জীবনে সান্ত্বনা হিসেবে কাজ করে, তেমনি শিল্পও এক সান্ত্বনার জগত তৈরি করে। ধর্ম যেমন মানুষের আত্মপরিচয়ের আকাক্সক্ষাকে জাগ্রত করে, তেমনি শিল্পও মানুষের পরিচয় বৈশিষ্ট্যকে মূর্ত করে। এই কারণেই দেখা যায় অনেক সময় ধর্ম ও শিল্প হাত ধরাধরি করে চলে। সামাদ লিখেছেন :

ধর্ম কাজ করেছে মানুষের সমস্যা-বিক্ষুব্ধ জীবনে সান্ত্বনা হিসেবে। আশার প্রতীক হিসেবে শিল্পেও সে সৃষ্টি করতে চেয়েছে এক অপার্থিব জগৎ, পরম সান্ত্বনার জগৎ। মানুষ অপ্রাপ্তব্যকে পেতে চেয়েছে তার ধর্ম ও শিল্প সাধনার মাধ্যমে।

একই কারণে দেখা যায় শিল্পের মধ্যেও বৈচিত্র্য আছে। আছে বিভিন্ন ধারা। এই বিভিন্নতা তৈরি হয়েছে মানুষের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রভাবের কারণে।

শিল্পকলা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে সামাদ এক জায়গায় লিখেছেন :

সামাদ যে কালের মানুষ সেসময় সমকালীন শক্তিশালী মতবাদ মার্কসবাদ সারা দুনিয়া দাপিয়ে বেড়িয়েছে। ফলে এসব চিন্তাভাবনা কমবেশি তাকেও প্রভাবিত করেছে। কিন্তু মার্কসবাদ তাকে নাড়া দিলেও তিনি মার্কসবাদী হননি। মার্কসের দার্শনিক ও সমাজতাত্ত্বিক ধ্যান-ধারণা সামাদকে প্রভাবিত করেনি। কিন্তু তিনি মনে করেন, মার্কসের অর্থনৈতিক চিন্তা যেকোনো দেশের অর্থনীতিকে বিশ্লেষণ করে তার মূল চরিত্র বুঝতে সহায়তা করে। সে হিসেবে তিনি মনে করেন বাংলাদেশের জাতীয় নীতিনির্ধারণে এখনো এরা সহায়ক হতে পারে। চেষ্টা হওয়া উচিত অপুঁজিবাদী (Non-capitalist) পন্থায় অগ্রসর হওয়া। পুঁজিবাদকে আঁকড়ে ধরা নয়।

তাহলে কি সামাদ মার্কসবাদী না হয়েও মার্কসবাদী অর্থনীতির সমর্থক? সেটাও না। সামাদ গণতন্ত্র চান। ব্যক্তি উদ্যোগ চান। কিন্তু সেই উদ্যোগের সীমাহীনতাকে প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাবদ্ধও করতে চান। সেদিক দিয়ে তিনি সম্ভবত গণতান্ত্রিক সমাজবাদী ও মিশ্র অর্থনীতির সমর্থক। মার্কসবাদ সম্বন্ধে তার কথা হলো, মার্কসের অনেক ভবিষ্যদ্বাণী খাটেনি। তার থিওরিতেও আছে অনেক রকমের ভুল। মার্কসবাদীরা ইতিহাসকে কেবল শ্রেণী সংগ্রাম দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু মানুষের ইতিহাস শুধু শ্রেণী সংগ্রামের ফল নয়। মানুষের পরস্পর সহযোগিতারও ইতিহাস। মার্কসের ধর্মচিন্তা ছিল বিশেষভাবে বিভ্রান্তিকর। তিনি ধর্মকে মনে করেছেন যাবতীয় অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের ফল। কিন্তু সামাদ বলেছেন, সব ধর্মের ব্যাখ্যার মধ্যেও আমরা দেখি মানবতাবাদের অনেক উন্নততর বিকাশ।

সামাদ শুধু মার্কসের থিওরির পূর্ণমূল্যায়ণ করেননি, মার্কসবাদীদের বিচ্যুতি নিয়েও লেখালেখি করেছেন এবং এই বিচ্যুতিগুলো তাদের পতনকে ত্বরান্বিত করেছে। তিনি লিখেছেন :

সব বাঙলা ভাষাভাষী মানুষ একত্র হয়ে এখনো এক রাষ্ট্র গড়তে চাচ্ছেন না। বাঙলা যাদের মাতৃভাষা তাদের ৬০% বাস করে বাংলাদেশে। আর বাকি ৪০ শতাংশ বাস করেন ভারতে। ভারতে বাংলাভাষী হিন্দুরা বাঙালি হতে চাচ্ছেন না, থাকতে চাচ্ছেন ভারতীয় হয়ে। শিখতে চাচ্ছেন রাষ্ট্রভাষা হিন্দি। আজকের বাংলাদেশের জাতিসত্তা কেবল ভাষাভিত্তিক নয়। ভাষা এর একটি মূল্যবান উপাদান। কিন্তু একমাত্র উপাদান নয়। এর আরেকটি উপাদান হলো ইসলামের স্বাতন্ত্র্য। আজকের বাংলাদেশ টিকে আছে বাঙলাভাষী মুসলমান আছেন বলেই। তারা হলেন- এ দেশের মেরুদণ্ড। আমি তাই বলব, সংস্কৃতির শিকড় খুঁজতে হলে খুব বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। খুঁজতে হবে ইসলামের স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে। আরেক কথায় ইসলামী ঐতিহ্যের (Tradition) মধ্যে।

তাই বাংলাদেশের মানুষ যে চেতনাকে নির্ভর করে পৃথক স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গড়ে তুলেছেন তাকে ঠিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ বলা চলে না। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভেতরে একটি আত্মপরিচয়গত বিভ্রান্তির সম্ভাবনা আছে, যা একটি স্বাধীন জাতি রাষ্ট্রের পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয়।

এই আত্মপরিচয়গত বিভ্রান্তি দূর করার জন্য তিনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন। কারণ রবীন্দ্রনাথকে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা তাদের সাংস্কৃতিক প্রতীক হিসেবে মনে করে। সামাদ লিখেছেন :

রবীন্দ্রনাথ বাঙলা ভাষায় লিখেছেন; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কখনোই বাঙলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদে আস্থাশীল ছিলেন না। তিনি আস্থাশীল ছিলেন নিখিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসী। কারণ তিনি ফিরে যেতে চেয়েছেন প্রাচীন বৈদিক যুগের সমাজ জীবনের মূল্যবোধে। তাই তিনি কখনোই আমাদের আদর্শ হতে পারেন না।

১৯৭১ এর ঘটনাবলীকেও সামাদ এমনভাবে মূল্যায়ন করেছেন যার সাথে বাঙালি জাতীয়তাবাদী মূল্যায়নের রয়েছে যথেষ্ট ভিন্নতা। এই ভিন্নতা তৈরি হয়েছে অভিজ্ঞতার ভিন্নতার কারণে। এ দেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদী বয়ান তৈরি হয়েছে উনিশ শতকের কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণবাদী ব্রাহ্মণ্যদের সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা থেকে, যে অভিজ্ঞতার মধ্যে পূর্ববাংলার বাঙালি মুসলমান ছিল অনুপস্থিত। পূর্ববাংলার মুসলমানরাও ছিল বাঙালি এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি। কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতা কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি সংস্কৃতিকেন্দ্রিক মহাকাব্যে স্থান পায়নি। তাই পূর্ববাংলার মুসলমান হেঁটেছে ভিন্নপথে। সেই ভিন্নপথের ইঙ্গিত দিয়েছেন এবনে গোলাম সামাদ:

কলকাতায় থাকার সময় আমি অনেক সময় গিয়েছি পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগঞ্জে। সেখানে কথা হয়েছে অনেক মুসলমানের সাথে। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, কেন আমরা মুক্তিযুদ্ধ করছি? পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানের চেয়ে আমরা তো আছি অনেক ভালো। আর ভোগ করছি অনেক বেশি বাস্তব রাজনৈতিক স্বাধীনতা। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের দেখে আমাদের চোখ খোলা উচিত।…

এক দিন আমাকে আমার এক পরিচিত ব্যক্তি নিয়ে যান বিখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের কাছে। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জিন্নাহ্র দ্বিজাতিতত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করছে। এতে তিনি খুবই খুশি হয়েছেন। আমি তার কথার মধ্যে কোনো কথা না বলে কেবলই শুনে গিয়েছিলাম তার বক্তব্য। কেবল অন্নদাশঙ্করই নন, অনেককেই বলতে শুনেছিলাম এই একই রকম কথা। আমি হয়তো বলতে পারতাম, বাংলাদেশের মানুষ চাচ্ছেন একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গড়তে। তারা মিশে যেতে চাচ্ছেন না ভারতের সাথে। তাই বাংলাদেশের অভ্যুত্থানকে বলা যায় না কেবলই দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধী। বলতে হয় তা কংগ্রেসের সাবেক এক জাতিতত্ত্বকেও মিথ্যা প্রমাণ করতে যাচ্ছে। এসব কিছু বলিনি; চুপ করে থেকেছি। কারণ, এ সময় এ রকম কথা বলার কোনো পরিবেশ ছিল না পশ্চিমবঙ্গে।

১৯৭১ সালের অভিজাত বাঙালি মুসলমানের চৈতন্যকে টুকরা টুকরা করে দিয়েছে। তার ইতিহাস চেতনা, সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় ও ধর্মবোধ হয়ে পড়েছে খণ্ডিত। তার জাতীয়তাবোধের ভেতরেও মতদ্বৈধতার শেওলা জমা হয়েছে। ঐক্য নয়, একাত্তর আমাদের এক বিচূর্ণিত চৈতন্যের উন্মেষ ঘটিয়েছে। এবনে গোলাম সামাদ মনে করেন, একাত্তর ও তার পূর্বাপর প্রেক্ষাপট নিয়ে যে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বয়ান তৈরি হয়েছে তা কিন্তু দিল্লির রাজনৈতিক ও কলকাতার সাংস্কৃতিক হস্তক্ষেপমুক্ত নয়। এই অন্যায্য হস্তক্ষেপ বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য নির্মাণের পথে বড় প্রতিবন্ধক। বাঙালি জাতিবাদী চিন্তার সীমাবদ্ধতার কারণে যে বিস্ময়কর কূপমণ্ডুকতা তৈরি হয়েছে যার ফলে বাঙালি মুসলমানের মননে ইসলাম প্রশ্নে এক দীর্ঘ দ্বিধা এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। এই দ্বিধা বাঙালি মুসলমানকে দোদুল্যমানতার শিকারে পরিণত করেছে। সামাদ মনে করেন, বাঙালি মুসলমানকে তার দ্বিধামুক্তির জন্য বৈদেশিক হস্তক্ষেপমুক্ত নিজস্ব সাংস্কৃতিক বয়ান গড়ে তুলতে হবে। যার ভিত্তি হবে ইসলাম। সেটাই হবে বাঙালি মুসলমানের শিকড়ে ফেরা।

পাঁচ.

এবনে গোলাম সামাদ নৃতাত্ত্বিক, শিল্পকলাবিদ ও সর্বোপরি একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান করেছেন। তার লেখার মূল সুরের মধ্যে এই অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটি সতত প্রবহমান। একজন ট্রাডিশনাল ধর্মতাত্ত্বিকের মতো তিনি বাঙালি মুসলমানকে পর্যালোচনা করেননি। তিনি একজন সমাজবিজ্ঞানীর চোখ দিয়ে বাঙালি মুসলমানের মন অনুধাবন করার চেষ্টা করেছেন। এটা তার আধুনিক মনের পরিচয়ও বটে।

সামাদের লেখালেখির একটা বড় অংশ জুড়ে আছে বাঙালি মুসলমানের স্বাতন্ত্র্যবাদের কথা। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বাঙালি মুসলমান যে জাতিরাষ্ট্রটি গড়ে তুলেছে তার স্বরূপ তিনি নির্দেশ করেছেন। বিশেষ করে এসব লেখালেখির ভেতরে তিনি এমন কতকগুলো প্রশ্নের অবতারণা করেছেন এবং তার জওয়াব খোঁজার চেষ্টা করেছেন যার ভেতর দিয়ে জাতিসত্তা বিষয়ক কুয়াশার অবসান হয়েছে।

এ দিক দিয়ে বলা যায়, তিনি বাংলাদেশের মানুষের জাতিসত্তার একজন মৌলিক ভাষ্যকার। তিনি তার বৌদ্ধিকতা দিয়ে এই ভাষ্যকে বিশেষভাবে করে তুলেছেন সারবান। সাংস্কৃতিক চিন্তার দিক দিয়ে তিনি একজন মুসলিম জাতীয়তাবাদী এবং রাজনৈতিক চিন্তার দিক দিয়ে তিনি হলেন গণতান্ত্রিক-সমাজবাদী। তার এই বিশেষ চিন্তাভাবনা বাঙালি মুসলমানের স্বাতন্ত্র্যবাদী বয়ানকে শক্তিশালী করেছে। বাঙালি মুসলমানের জাতিরাষ্ট্রটি যতদিন টিকে থাকবে তার লেখালেখি বিশেষ করে সাংস্কৃতিক বয়ান ততদিন মহাকালের সামনে কখনোই জীর্ণ হবে না।

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ