১৮৯৮ সালে রাশিয়াতে সে সময়ের জার্মানির অনুকরণে গঠিত হয় সোস্যাল ডেমক্র্যাটিক পার্টি। এই দলটি ১৯০৩ সালে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একভাগ নাম পায় মেনসেভিক। আর একভাগ নাম পায় বলসেভিক। ১৯১৮ সাল থেকে বলসেভিক পার্টি নিজেকে অভিহিত করে কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে। মেনসেভিকরা চান রাশিয়াকে প্রথমে একটি গণতান্ত্রিক রিপাবলিকে পরিণত করতে। তারপর সে দেশে আইন করে ধাপে ধাপে রাষ্ট্রিক নিয়ন্ত্রণে সমাজতান্ত্রিক অর্থ গড়ে তুলতে। অন্য দিকে বলসেভিকরা চান জোর করে ক্ষমতা দখল করে বলসেভিক পার্টির নেতৃত্বে রাশিয়ায় তথা রুশ সাম্রাজ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়তে।
বলসেভিক পার্টির নেতা ছিলেন লেনিন। তিনি উদার গণতন্ত্রে আস্থাশীল ছিলেন না। তিনি উদার গণতন্ত্রকে বলতেন পুঁজিবাদীদের একনায়কত্ব (Dictatorship of Capital)। আর কমিউনিস্ট পার্টির একনাকত্বকে তিনি অভিহিত করেন সর্বহারা একনায়কত্ব (Dictatorship of the Proletariat)। লেনিন বলতেন, তিনি হলেন দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ কার্ল মার্কসের খাঁটি শিষ্য। কিন্তু কার্ল মার্কস বিলাতে চার্টিস্ট আন্দোলন সমর্থন করেন এবং বলেন যে, বিলাতে ভোটের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্ভব। যদিও তিনি পরবর্তীকালে বলেন, সমাজতন্ত্রের জন্য একটি বিপ্লবী দলকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে হবে। আর সেই বিপ্লবী দল গড়বে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি। লেনিন এই ধারণাটিকে বিশেষভাবে গ্রহণীয় বলে মনে করেন।
বর্তমানে বাংলাদেশে যখন মানুষ চাচ্ছে উদার গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, তখন এ দেশের বেশ কিছু পত্রপত্রিকা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশ কিছু সংখ্যক অধ্যাপক করছেন লেনিনবাদের জয়গান। মনে হচ্ছে তারা চাচ্ছেন এ দেশে এক ভয়াবহ স্বৈরশাসনেরই প্রবর্তন। রুশ বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৯১ সালে ভেঙে পড়েছে ১৫টি রিপাবলিক নিয়ে গঠিত সোভিয়েত ইউনিয়ন। এখন এরা প্রত্যেকে পরিণত হয়েছে একেকটি পৃথক রিপাবলিকে। আর এসব রিপাবলিকে মানুষ চাচ্ছে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনীতিতে চাচ্ছে ধনতন্ত্রের আরেক কথায় বাজার অর্থনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা। সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি রিপাবলিকের মধ্যে সবচেয়ে বড় রিপাবলিক ছিল রাশিয়া। রাশিয়ায় এখন জেগে উঠেছে এক প্রবল রুশ জাতীয়তাবাদের বন্যা। রাশিয়ার পতাকা এখন হয়েছে সাবেক রুশ সম্রাটদের পতাকা। যাতে আঁকা হয়েছে জোড়া ঈগলের প্রতীক। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো রিপাবলিকেই উড়ছে না কাস্তে-হাতুড়ি অঙ্কিত লাল পতাকা। কেননা এই সাবেক ১৫টি রিপাবলিকের কোনোটিতেই কমিউনিস্ট পার্টি আর নেই ক্ষমতায়। কিন্তু আমাদের অধ্যাপকরা জয়গানে ব্যস্ত ১৯১৭ সালে লেনিনের নেতৃত্বে সংঘটিত রুশ বিপ্লব নিয়ে।
লেনিনের রুশ বিপ্লব আসলে ছিল একটা সফল সামরিক ক্যুদেতা মাত্র। এর পরপরই রাশিয়াতে হয়েছিল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, যাতে মারা যায় কম করে ৫০-৬০ লাখ লোক। তবে লেনিনের কমিউনিস্ট পার্টি হয়ে উঠেছিল খুবই সুগঠিত। তারা ধরে রাখতে পারে ক্ষমতা। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে তাসের ঘরের মতো। এই ভেঙে পড়ার একটা বড় কারণ হলো খোদ রাশিয়া, ইউক্রেন ও বাইলোরশিয়ার মধ্যে জাতিসত্তার সঙ্ঘাত। ইউক্রেন ও বাইলোরশিয়া বেরিয়ে যেতে চায় সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ১৯৯০ সালে। ১৯৯১ সালে ভেঙে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন। বর্তমানে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে চলেছে যুদ্ধ। অথচ একসময় বলা হতো সোভিয়েত ইউনিয়নে জাতিসত্তার সমস্যা আর নেই। তাই গঠিত হতে পেরেছে বহুজাতিক মিলনে বিরাট সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু এখন এই প্রচারণা প্রমাণিত হয়েছে সম্পূর্ণ মিথ্যা হিসেবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার আরেকটি কারণ হলো, রাষ্ট্র পরিচালিত অর্থনীতির ব্যর্থতা। লেনিনের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন জোসেফ স্টালিন (১৮৭৯-১৯৫৩)। স্টালিন সোভিয়েত ইউনিয়নে ক্ষমতায় ছিলেন একটানা প্রায় ৩০ বছর। স্টালিন চান সোভিয়েত ইউনিয়নে দ্রুত কলকারখানার অর্থনীতি গড়ে তুলতে। তিনি এই লক্ষ্যে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন ১৯২৮ সালে। স্টালিনের শাসনামলে সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় যন্ত্রপাতি গড়ার কারখানা (Industry Producing Means of Production)। কিন্তু অবহেলিত হয় ব্যবহার্য দ্রব্যাদি গড়ার কলকারখানা (Industry Producing Consumers Goods)। ফলে অর্থনীতি হারায় ভারসাম্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অভাব হয়ে ওঠে চরম প্রকট। সবচেয়ে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন ব্যবস্থায়।
স্টালিনের আমলে কৃষকদের কাছ থেকে জোর করে খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করে খাওয়াবার ব্যবস্থা হয় শহরের কলকারখানায় নিয়োজিত শ্রমজীবীদের এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নিয়োজিত কর্মচারীদের ভরণপোষণের লক্ষ্যে। স্টালিন গড়েন যৌথ কৃষিখামার (Collective Farm) ব্যবস্থা। কিন্তু এতে খাদ্য উৎপাদন না বেড়ে কমে যেতেই থাকে। বহু মানুষকে থাকতে হয় অনাহার ও অর্ধাহারে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি হয় চুড়ান্তভাবে ব্যর্থ। কিন্তু স্টালিনের স্বৈরশাসনে মানুষ পারে না এর প্রতিবাদ করতে। এমনকি সাধারণভাবে সমালোচনা করতে। স্টালিনের ভয়াবহ স্বৈরশাসন সম্পর্কে বিশ্ববাসী বিশেষভাবে জ্ঞাত হতে পারে স্টালিনের মৃত্যুর তিন বছর পর ১৯৫৬ সালে খ্রুশ্চফ্-এর বক্তৃতা থেকে। স্টালিন মারা যাওয়ার পর খ্রুশ্চফ্ হন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক। তিনি ১৯৫৬ সালে দেন স্টালিন সম্পর্কে এক বিশেষ বক্তৃতা, যাতে কেবল স্টালিনের স্বৈরশাসনের ভয়াবহ রূপ ফুটে ওঠে না, জানা যায় লেনিনের সর্বহারা একনায়কত্বের পরিণতি সম্বন্ধেও। সোভিয়েত ইউনিয়ন সবচেয়ে উন্নতি করে সমর বিজ্ঞানে। প্রথম পরমাণু বোমা বানায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যা সে নিক্ষেপ করে ১৯৪৫ সালে জাপানের ওপর। এ সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় ১৯৪৯ সালে। সে প্রথম তার হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণ ঘাটায় ১৯৫৩ সালে। এর আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণ ঘটাতে পেরেছিল। ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করে। সে ১৯৬১ সালে মানুষসহ কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণে সক্ষম হয়। এ ক্ষেত্রে সে এগিয়ে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। কিন্তু এসব করতে গিয়ে সে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে, তাতে তার অর্থনীতি হয়ে পড়ে প্রায় দেওলিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার একটি কারণ হলো জাতিসত্তার দ্বন্দ্ব। আরেকটি কারণ হলো, তার অর্থনীতিতে বিরাট ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি। কিন্তু আমাদের দেশের অধ্যাপকরা বলছেন, ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি সারা বিশ্বে চড়ায় ঠেকেছে। এ দেশে নাকি করতে হবে ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের মতো বিপ্লব। যেটাকে আমাদের মতো অনেকের কাছে মনে হচ্ছে যুক্তিহীন উচ্ছ্বাস হিসেবে।
১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে। ভারত এ সময় করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ২৫ বছরের শান্তি-মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি, যা আসলে ছিল একটি সামরিক চুক্তি। ভেতরে কথা ছিল সাবেক পাকিস্তান পরাজিত হলে সোভিয়েত ইউনিয়নকে দিতে হবে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্তৃত্ব। ১৯৭১-এর যুদ্ধের পর চট্টগ্রাম বন্দরের কর্তৃত্ব চলে যায় প্রায় সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্তৃত্বে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সেখানে গড়ে তুলতে থাকে সাবমেরিন ঘাঁটি। ১৯৭৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির তখনকার সাধারণ সম্পাদক ল. ই. ব্রেজনেভের পরামর্শে বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমান মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের সাথে নিয়ে গড়েন একদলীয় বাকশাল রাজত্ব, কতকটা সোভিয়েত ইউনিয়নেরই অনুকরণে। কিন্তু এর ফলে ঘটে সামরিক অভ্যুত্থান। সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্তৃত্ব বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হতে গিয়েও হতে পারেনি। প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে আওয়াজ ওঠে, রুশ-ভারতের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান। ১৯৮০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান দখল করে এবং অগ্রসর হতে চায় পাকিস্তানের মধ্যে। কিন্তু সে এই যুদ্ধে হয় প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন। পাক সৈন্যরা আফগানিস্তানের যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্যকে বিশেষভাবে বাধা দিতে সক্ষম হয়। একটি হিসাব অনুসারে এই যুদ্ধে মারা যায় কম করে ১৮ হাজার সোভিয়েত সৈন্য। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, আফগান যুদ্ধ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার একটা আনুষঙ্গিক কারণ। যখন আফগানিস্তানে পাকফৌজের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্যদের তুমুল যুদ্ধ চলছিল, তখন বাংলাদেশে মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরা (সিপিবি) ১৩ জানুয়ারি (১৯৮০) ঢাকায় এক জনসভায় ঘোষণা করেছিল, বাংলাদেশে আফগানিস্তানের মতো বিপ্লব করতে হবে; কিন্তু তারা কিছুই করে উঠতে পারেনি। আজ তাদেরই ঐতিহ্যবহরা ঢাকায় বর্তমানে কলরব তুলেছেন, ১৯১৭ সালের ‘মহান রুশ বিপ্লব’-এর শতবার্ষিকী পালনের জন্য।
দৈনিক নয়াদিগন্ত, ২৬ আগস্ট ২০১৭।