আমরা ভাষা নিয়ে আলোচনা করছি ভাষাতত্ত্বের ছাত্র হিসেবে নয়। ভাষা নিয়ে আলোচনা করছি, কেননা ভাষা জড়িয়ে পড়েছে রাজনীতির সাথে। ভাষা সম্পর্কে তাই বেশ কিছু কথা জানা আমাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে, ভাষাতত্ত্বের প্রয়োজনে নয়, রাজনীতির প্রয়োজনে। যে রাজনীতির লক্ষ্য হলো ক্ষমতার লড়াইয়ে জেতা নয়, জাতি গড়া। সেই হিসেবেই করতে হবে বর্তমান আলোচনার মূল্য নিরূপণ। অন্যভাবে নয়।
কিছু দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক অধ্যাপকের লেখা পড়েছিলাম ‘সংস্কৃতির মর্মকথা’ নামে (যুগান্তর, ৩ ফেব্রয়ারি ২০১৭)। লেখক বলেছেন, বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যে আমাদের সংস্কৃতির মর্মকথা অনুধাবন করতে হবে। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যে আমরা কি আমাদের মর্মকথাকে আদৌ খুঁজে পেতে পারি! বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা একটি প্রবন্ধ আছে, যার নাম হলো ‘বাঙালির উৎপত্তি’। এই প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, বাংলা ভাষায় যারা কথা বলে তাদের মধ্যে আছে কোল, দ্রাবিড় ও আর্য মানবধারার লোক। বাঙালিদের তাই ঠিক এক জাতির মানুষ বলা যায় না। যদিও তারা সবাই এক ভাষায় কথা বলে। ইংরেজদের বলা যায় এক জাতি। যদিও তারা গঠিত হয়েছে স্যাকসন, ডেন, নরমান মানব সমষ্টির সমন্বয়ে। কিন্তু এই সমন্বয় ঘটতে পারার কারণ হলো স্যাকসন, ডেন, নরমানরা হলো একই মূল আর্য মানবধারার মানুষ।
কিন্তু বাংলা ভাষায় যারা কথা বলে তারা সবাই এক মানবধারার মানুষ নয়। তাদের মধ্যে আছে কোল, দ্রাবিড় ও আর্য। বাংলা ভাষা আর্যদের ভাষা। কোল, দ্রাবিড়রা এ ভাষা শিখেছে আর্যদের কাছ থেকে। বাংলাভাষীদের মধ্যে খাঁটি আর্য হলো ব্রাহ্মণরা। তাদের ভাষাই হলো আর্যভাষা বাংলা। বঙ্কিমচন্দ্র বাংলাভাষী মুসলমানকে বলেছেন, আগন্তুক জাতি। এরা বাংলা ভাষায় কথা বললেও এদের কোনোভাবেই বলা চলে না বাঙালি। তিনি তার প্রবন্ধে বাংলাভাষী মুসলমানের সম্পর্কে করেছেন খুবই অবমাননাকর মন্তব্য। অথচ আমাদের অধ্যাপকেরা বলছেন, বঙ্কিমচন্দ্রের চিন্তাভাবনার মধ্যে খুঁজতে হবে আমাদের ঐতিহ্যকে। আজকের বাংলাদেশ বাংলাভাষী মুসলমানের সংগ্রামের ফল। বঙ্কিমচন্দ্র যাদের বাঙালি বলেই স্বীকার করতে চাননি। বলেছেন অবাঞ্ছিত, হীন-বংশোদ্ভব জাতি। ভাষা সম্পর্কে তাই আমাদের জানা প্রয়োজন।
বাংলা ভাষা কতটা আর্য তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। কেননা, বাংলা ভাষার ব্যাকরণের সঙ্গে দ্রাবিড় ভাষার ব্যাকরণের যথেষ্ট মিল পাওয়া যাচ্ছে। যেমন দ্রাবিড় ভাষায় ক্রিয়াপদ ছাড়া বাক্য গঠন করা চলে। বাংলা ভাষাতেও যায়। এ ছাড়া বাংলা ভাষাতে জোড়ালাগা শব্দ আছে। যেমন, আমরা বলি ছেলেগুলো। এখানে ছেলে আর গুলো শব্দ দুটি আলাদা। কিন্তু এরা একত্র হয়ে একটি তৃতীয় অর্থ প্রকাশ করছে। যেটা হলো দ্রাবিড় ভাষার রীতি। আমরা বলি, বসে পড়ল। এখানে বসে এবং পড়ল দু’টি আলাদা শব্দ। কিন্তু বসে’র সঙ্গে পড়া যোগ করার ফলে অর্থটি অনেক সবল হতে পারল। অনেক কিছুই আমরা ডাবল ডাবল বলি। যেমনÑ অশ্র“-জল, ভুল-ভ্রান্তি। এসব আর্যভাষার রীতি নয়। বাংলা ভাষায় বিভক্তি প্রয়োগ অনেক কম। আমরা মানুষকে বাঘ খায়, এ কথা না বলে অনেক সময় বলি, ‘মানুষ বাঘ খায়’। যেটা আর্যভাষার রীতি নয়। আর্য বংশের অন্য ভাষার তুলনায় বাংলা ভাষার উচ্চারণরীতি অনেক সহজ। এসব দিক থেকে বিচার করলে বলতে হয় বাংলা একটা স্বতন্ত্র ভাষা। যার একটা পৃথক ইতিহাস আছে। এ পর্যন্ত যেসব পুরাতন বাংলা পুঁথি পাওয়া গেছে, তার মধ্যে (চর্যাপদ ছাড়া) সবচেয়ে প্রাচীন পুঁথি হলো শাহ মুহাম্মদ সগীরের (সগিরি) লেখা ইউসুফ-জুলিখা। শাহ মুহাম্মদ সগীর হলেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের রাজত্বকালের লোক (১৩৯০-১৪১০ খ্রিষ্টাব্দ)। সগীরের বাংলার কিছু নমুনা নেয়া যেতে পারে।
চতুর্থে কহিমু কিছু পোথাক কথন।
পাপ ভয় এড়ি লাজ দড় করি মন ॥
নানা কাব্য কথা রসে মজে নরগণ।
যার যেই শ্রদ্ধায় সন্তোষ করে মন।
ন লেখে কিতাব কথা মনে ভয় পাএ ॥
দোষিব সকল তাক ইহ ন জুয়াএ ॥
গুণিয়া দেখিলুঁ আহ্মি ইহ ভয় মিছা।
ন হয় ভাষায় কিছু হয় কথা সাচা ॥
ইছুফ জলিখা কিচ্ছা কিতাব প্রমাণ।
দেশী ভাষে মোহাম্মদ সগীরিএ ভান ॥
মুসলমান সাহিত্যিকেরা বাংলা ভাষার মাধ্যমে চেয়েছেন ইসলাম প্রচার করতে। কবি সৈয়দ সুলতান (১৫৫০-১৬৪৮ খ্রিষ্টাব্দে) তার নবী বংশ’র প্রস্তাবনায় লিখেছেন,
আল্লায়-এ বুলিছে মুঞই যে দেশে যে ভাষ।
সে দেশে সে ভাষে কৈঁলু রসুল প্রকাশ ॥
এক ভাষে পয়গম্বর এক ভাষে নর।
বুঝিতে ন পারিব উত্তর পদুত্তর ॥
শাহ মুহাম্মদ সগীর এবং সৈয়দ সুলতান উভয়ই ছিলেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসী। চট্টগ্রাম অঞ্চলে আরো অনেক বাংলাভাষী মুসলিম সাহিত্যিক জন্মেছেন। এরা সবাই সাহিত্য রচনা করেছেন তাদের সময়ের আদর্শ বাংলায়। এদের কারও লেখাতেই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাংলার প্রভাব থাকতে দেখা যায় না। রাখাইনের (আরাকানের) রাজারা একসময় ছিলেন গৌড়ের সুলতানদের সামন্ত। এরা বাংলা ভাষা জানতেন ও বুঝতেন। এদের রাজসভায় তাই হতে পেরেছে বাংলা সাহিত্যের চর্চা। কবি আলাওল হতে পেরেছেন তখনকার আরাকানের রাজসভার কবি। অনেকের মতে, আলাওলকে ধরা চলে সপ্তদশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে। আলাওল অনেকগুলো ভাষা জানতেন। তিনি তার বিখ্যাত পদ্মাবতী বইটি লিখেছেন হিন্দি কবি মালিক মুহাম্মদ জায়সীর পাদুমাবৎ কাব্যের অনুসরণে। মালিক মুহাম্মদ জায়সী তার বইটি লিখেছেন পূর্বী হিন্দি বা কোসলী ভাষায়। পূর্বী হিন্দি ছাড়াও আলাওল জানতেন উড়িয়া ভাষা। ফারসি ভাষাতেও তার ছিল পাণ্ডিত্য। তিনি ফারসি ভাষা থেকে অনুবাদ করেছিলেন সিকান্দারনামা ও হফ্ত পয়কর (সাত রাজপুত্রের কাহিনী)। বাংলাভাষী মুসলমানদের ওপর আগাগোড়াই থেকেছে ফারসি ভাষা-সাহিত্যের বিশেষ প্রভাব। নবাবী আমলে রচিত হয়েছে ময়মনসিংহ গীতিকা’র কাহিনীগুলো। এদের বলা যায় উপন্যাসের লক্ষণাক্রান্ত। এগুলো ঠিক লোক সাহিত্যের নিদর্শন নয়। কেননা, এসব কাহিনীর রচকদের নাম পাওয়া যায়। এসব কাহিনী যারা রচনা করেছেন, তাদের অনেকেই হলেন বাংলাভাষী মুসলমান। মুসলিম নৃপতিদের শাসনামলে মুসলিমবিশ্ব থেকে অনেক কাহিনী এসেছে বাংলাদেশে; আর তারা কথিত হয়েছে বাংলা ভাষায়। হয়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্যেরই অংশ। যেমন হাতেম তাই, লায়লী মজনু, চাহার দরবেশ, গোলেব-কাওলি ইত্যাদি। যেসব কাহিনী বাংলাভাষী মুসলমান হিন্দু সবাই একসময় মশগুল হয়ে শুনেছে।
এ দেশে একসময় ছিলেন অনেক গল্প-কথক। যারা গান গেয়ে গল্প বলতেন। মুসলিম নৃপতিদের শাসনামলেই বাংলা সাহিত্যে এসে যুক্ত হয়েছে জীন-পরীর ধারণা। এই ইতিহাসকে বাদ দিয়ে আজকের বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতিকে বুঝবার চেষ্টা বিশেষভাবেই অবান্তর। বাংলাভাষী মুসলমান চিরদিন বাংলা ভাষাতেই সাহিত্য করেছেন। মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৮-১৯১২) খুব উন্নতমানের সাধু-বাংলা গদ্য লিখেছেন। তার রচিত সাহিত্যের মূল্যায়ন এখনো যথাযথভাবে হয়নি। তার লেখা বিষাদ সিন্ধু (১৮৯১) উপন্যাসের হিন্দি অনুবাদ করেন কবীন্দ্র বেণীপ্রসাদ বাজপেয়ী (১৯৩০)। কবি জসীমউদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬) রচনা করেন তার বিখ্যাত কাব্য কাহিনী নকশীকাঁথার মাঠ, যা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন Mrs E. M. Milford, The Field of the Embroidered Quilt নামে। যা পায় বিশ্বজোড়া খ্যাতি। এসব কথা বলতে হচ্ছে এই জন্য যে, কিছু ব্যক্তি উঠেপড়ে প্রমাণ করতে লেগেছেন যে, ইউনেস্কো একুশে ফেব্রয়ারিকে মাতৃভাষা দিবস করার জন্য বিশ্ব জেনেছে বাংলাভাষা বলে একটা ভাষা আছে। কিন্তু ইউনেস্কোর জন্মের অনেক আগে থেকেই বাংলা ভাষা তার রস-সাহিত্যের জন্য লাভ করতে পেরেছে বিশ্বজোড়া খ্যাতি। কিছু দিন আগে (যুগান্তর, ২০ ফেব্র“য়ারি ২০১৭) বাংলাদেশীরাই অর্জন করল ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ নামে একটি প্রবন্ধ পড়লাম। যাতে লেখক প্রমাণ করতে চেয়েছেন, ১৯৪৮ সালে প্রেম হরি বার্মা, ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত ও শীরিষচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পাকিস্তান কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে তোলেন বাংলা ভাষার দাবি। যার ফলেই হতে পেরেছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন।
কিন্তু প্রকৃত ঘটনা তা ছিল না। বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা বলেছেন, বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা যায় কি না এ নিয়ে ছাত্র এবং বুদ্ধিজীবী মহলে প্রথম চিন্তার সূত্রপাত করে ‘তমদ্দুন মজলিস’। এই তমদ্দুন মজলিস ছিল ইসলামিক আদর্শে প্রভাবিত আধা-রাজনৈতিক এবং আধা-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম ভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র এবং কিছু শিক্ষকের উদ্যোগে এই প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। ‘সুরুজ-জামাল’ মেসের একটি পুরাতন দালানের (পরবর্তীকালের রশিদ বিল্ডিং) ওপরের তলায় তমদ্দুন মজলিসের অফিস স্থাপিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানই প্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলে এবং ভাষা আন্দোলনের পথ উন্মোচন করে। পরবর্তী পর্যায়ে ছাত্ররা একে সামগ্রিক রূপ প্রদান করে (মহান একুশে সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থ। অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ঢাকা ২০০৮। পৃষ্ঠা ১৪৩৮)।
অর্থাৎ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল মুসলিম তরুণদেরই উদ্যোগে। অনেকে এখন বলছেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আর বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কিন্তু যা মনে রাখা হচ্ছে না, তা হলো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়েছিল সাবেক পাকিস্তান রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যতম দাফতরিক ভাষা করার জন্য। সাবেক পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ভেঙে দেয়ার জন্য নয়। কেননা, সে দিন রাষ্ট্র বলতে বুঝিয়েছে সাবেক পাকিস্তান রাষ্ট্রকে। কেবল পূর্ববাংলা প্রদেশকে নয়। এখন অনেকের লেখা পড়ে মনে হচ্ছে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যেন ছিল তদানীন্তন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সঙ্ঘাত। কিন্তু বাস্তবে তা ছিল না। কেননা তখন মানুষ ভাবেনি পাকিস্তান বলতে কেবলই বুঝতে হবে তদানীন্তন পাকিস্তানের পশ্চিমাংশকেই। কারণ রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্নটি ছিল সমগ্র পাকিস্তানকে একটি রাষ্ট্র ধরে নিয়ে, দু’টি রাষ্ট্র কল্পনা করে নিয়ে নয়; এখন যেমন ধারণা দেয়া হচ্ছে। যদিও বলা হয়েছে, যেহেতু পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে রয়েছে ভৌগোলিক ব্যবধান, তাই এই ভৌগোলিক বাস্তবতাকেও নিতে হবে বিবেচনায়। পাকিস্তান রাষ্ট্র ঠিক অন্য রাষ্ট্রের মতো নয়।
আমাদের অনেক বুদ্ধিজীবী বলছেন, ভাষা আন্দোলন নাকি ছিল সব ভাষার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার। বাংলাদেশের মানুষ পৃথিবীর সব ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে দেয়ার যোগ্যতা রাখে না। প্রয়োজনও দেখে না। কেননা, সব ভাষা সমান অগ্রসর নয়। এ ছাড়া সব ভাষা একইসংখ্যক মানুষ বলে না। যেসব ভাষা খুব কমসংখ্যক মানুষ বলে, তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাকে রক্ষা করা যাবে না। বহু ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যেমন বিলাতে কর্নিশ বলে একটি ভাষা ছিল, যা আজ আর নেই। ইংরেজি ভাষা এখন ইংল্যান্ডে একাধিকার লাভ করেছে। যদিও ওয়েলস-এ এবং স্কটল্যান্ডে করেনি। কিন্তু ওয়েলস এবং স্কটল্যান্ডের মানুষ কার্যত ইংরেজি ভাষায় করছে তাদের ভাব প্রকাশ ও সাহিত্যচর্চা। বাংলাদেশে উপজাতিরা সংখ্যায় বেশি নয়। তাদের হাটে বাজারে লেনদেন করতে হচ্ছে বাংলা ভাষার মাধ্যমে। লেখাপড়া শিখতে হচ্ছে বাংলাভাষার মাধ্যমে। অফিস আদালতে চাকরি করতে হলে কথা বলতে হচ্ছে, লিখতে হচ্ছে বাংলা ভাষায়। এমতাবস্থায় জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে বাংলা তাদের শিখতেই হবে। আর তাই ধীরে ধীরে বাংলাই হবে তাদের ভাষা। না হলে জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে তারা পড়বেন বিশেষ সঙ্কটেরই মধ্যে। জানি না কেন আমাদের দেশের কিছু বাম-বুদ্ধিজীবী ক্ষুদ্র নৃ-জাতিসত্তার স্বার্থ রক্ষার জন্য এত কথা বলছেন। তারা কি চাচ্ছেন বাংলাদেশকে ক্ষুদ্র নৃ-জাতিসত্তার স্বার্থ রক্ষার নামে টুকরো টুকরো করে ফেলতে?
আমাদের বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা চোখের ওপর দেখলেন ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে ১৫টি রিপাবলিক নিয়ে গঠিত সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে পড়তে। যতগুলো কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে, তার মধ্যে একটি কারণ হলো জাতিসত্তার সঙ্ঘাত। আমাদের একটি বিরাট ভুল ধারণা ছিল যে, সোভিয়েত ইউনিয়নে সব ভাষার সমান মর্যাদা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা ছিল না। সবাইকে শিখতে হতো রুশ ভাষা। রুশ ভাষা শেখা ছিল সবার জন্য বাধ্যতামূলক। এমনকি হাঙ্গেরি দখল করে রাশিয়া সেখানে রুশ ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক করেছিল। যতগুলো কারণে হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত ইউনিয়নবিরোধী অভ্যুত্থান ঘটেছিল, তার মধ্যে একটি কারণ ছিল এই বাধ্যতামূলক রুশ ভাষা শিক্ষা প্রদান করা। কিন্তু আমাদের দেশে উপজাতিরা সংখ্যায় অনেক কম। তাদের বাস করতে হবে আমাদেরই মধ্যে, আমাদের ভাষা শিখে। সুতরাং এই পরিস্থিতি হলো অনেক ভিন্ন। মার্কসবাদ সব ভাষার সমান অধিকার দিতে পারেনি। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নেও পেরেছিল না। যদিও মার্কসবাদীরা বলেন, সব ভাষার থাকতে হবে সমান অধিকার। মার্কসবাদ শ্রেণী সংগ্রামের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সব কমিউনিস্ট মেনুফেস্টোতে কোথাও ভাষা সমস্যা সম্পর্কে একটি কথাও বলা হয়নি। বলা হয়েছে মানুষের ইতিহাস, শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। কোনোখানেই বলা হয়নি মানুষের ইতিহাস ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস। আসলে জাতিসত্তা নিয়ে কার্ল মার্কস ও ফেডরিক অ্যাঙ্গেলস কোনো কিছুই ভাবেননি। কিন্তু আমাদের দেশের মার্কসবাদীরা বলছেন সব ভাষার দিতে হবে সমান অধিকার। কেবল তাই নয়, আমাদের দেশে একটা আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউটও করা হয়েছে। অথচ আমরা ইংরেজি ভাষাই শিখতে চাচ্ছি না আর আগের মতো। যদিও এই ভাষার মাধ্যমে আমরা বিশ্বের জ্ঞানবিজ্ঞান ও চিন্তাচেতনার জগতের সাথে রাখতে পারি অনেক সহজেই যোগাযোগ। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমেই লাভ করতে পারি অনেক সহজেই কৃতকৌশল।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় আমাদের মধ্যে বিরাজ করছিল না কোনো ইংরেজি ভাষাবিরোধী মনোভাব। কিন্তু এখন যেন বোঝাবার চেষ্টা হচ্ছে, এটাও ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার অন্যতম লক্ষ্য। সব ধারণাই দেয়া হচ্ছে উলটপালট করে। বাংলা ভাষায় বহু ব্যাপারেই উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক নেই। ছাত্র পড়াবার ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে বিরাট বিপর্যয়। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে বলা হচ্ছে জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলার প্রচলন করতে হবে। কিন্তু কেবল রাজনীতি করে তো আর বাংলা ভাষায় নানা বিষয়ে প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক রচনা করা সম্ভব হবে না। সব কিছুতেই রাজনীতি মিশিয়ে জাতীয় সমস্যাকে করে তোলা হচ্ছে অতি জটিল।
দৈনিক নয়াদিগন্ত, ০৪ মার্চ ২০১৭