ইংরেজি ভাষায় Science শব্দটা এসেছে ল্যাটিন Scientia শব্দ থেকে। ল্যাতিন ভাষায় Scientia শব্দের মানে হলো জ্ঞান। আমরা বাংলায় ইংরেজি Science শব্দটার বাংলা করেছি বিজ্ঞান। বিজ্ঞান শব্দটার অর্থ কিন্তু চিরকাল এক রকম ছিল না। এখন আমরা বিজ্ঞান বলতে বুঝি, বিশেষ ধরনের জ্ঞানকে। ইংরেজিতে Science বলতে সব রকমের জ্ঞানকে বোঝায় না। বোঝায় সাধারণত সুনির্দিষ্ট জ্ঞানকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো সুনির্দিষ্ট জ্ঞান বলতে ঠিক কী ধরনের জ্ঞানকে বুঝতে হবে, সেটি নিয়ে।
গল্প আছে প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্ততল (৩৮৪-৩২২ খৃ. পূ.) মনে করতেন, ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের মুখে দাঁতের সংখ্যা হলো কম। অ্যারিস্ততল জীবনে দুইবার বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু তিনি কখনোই তার স্ত্রীদের মুখে কতগুলো দাঁত আছে সেটি গুনে দেখার প্রয়োজন মনে করেননি। অ্যারিস্ততল যদি দার্শনিক না হয়ে বৈজ্ঞানিক হতেন, তবে মেয়েদের মুখে কতগুলো দাঁত আছে, সেটি তিনি গুনে দেখতেন। বিজ্ঞান বলতে বোঝায় এ রকম গুনে দেখা জ্ঞানকে। যা অনেক সুনির্দিষ্ট। সব জ্ঞানকে বিজ্ঞান বলা যায় না। বিজ্ঞান হলো যাচাই যোগ্য জ্ঞান। অনেক পরে বিলাতের বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক লর্ড কেলভিন (১৮২৪-১৯০৭) বলেন, ও I often say that if you can measure that of which you speak, and can express it by number, you know something of your subject, but if you can not measure it, your knowledge is meager and unsatisfactory. অর্থাৎ মাপজোখলব্ধ জ্ঞান হলো বিজ্ঞান। বিজ্ঞান হলো এমন জ্ঞান, যাকে সংখ্যার সাহায্যে প্রকাশ করা চলে।
কেলভিনের এই বক্তব্যের মধ্যে যথেষ্ট যথার্থতা আছে। কিন্তু সব জ্ঞান গুনতির মধ্যে যে পড়ে এমন নয়। যেমন, পটাশিয়াম সায়ানাইট হলো বিষ। বিষ, এই শব্দটাকে সংখ্যার মাধ্যমে আমরা প্রকাশ করতে পারি না। কিন্তু পটাশিয়াম সায়ানাইট যে বিষ, এটি বৈজ্ঞানিক সত্য। এই সত্য অবশ্য আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ। অনেক মানুষকে দেখা গিয়েছে পটাশিয়াম সায়ানাইট খেয়ে মারা যেতে। তাই আমরা মনে করি পটাশিয়াম সায়ানাইট বিষ। বিজ্ঞানের আর একটি সংজ্ঞা হলো যন্ত্রের সাহায্যে লব্ধ জ্ঞান। জীবাণুদের খালি চোখে দেখা যায় না। কিন্তু দেখা যায় মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে। মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কৃৃত না হলে জীবাণুদের সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অজ্ঞাত থেকে যেত। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতি হতে পারত না।
গ্যালিলিও (১৫৬৪-১৬৪২) তাঁর নিজের হাতে তৈরি করা দুরবিন দিয়ে বৃহস্পতির চাঁদ আবিষ্কার করেন। তিনি অনেককে ডেকে তাঁর দুরবিনের সাহায্যে বৃহস্পতির চাঁদ দেখান। কিন্তু তাঁরা এটি মানতে চান না। বলেন যে, গ্যালিলিও তাদের ভেলকি দেখাচ্ছেন। পরে গ্যালিলিওর তৈরি দুরবিন ব্যবহার করে ইটালির তাসকেনিয়ার সৈন্যরা দূর থেকে গোলা ছুড়ে যুদ্ধে জিততে থাকেন। গ্যালিলিও-এর দুরবিন আর থাকে না ভেলকিবাজি হয়ে। কেননা, তা লাগতে থাকে যুদ্ধের কাজে। এখনকার যুদ্ধে বিজ্ঞান আরো সহায়ক হয়ে উঠেছে। তাই মনে করা হয়, বিজ্ঞানের জ্ঞান অনেক নিশ্চিত। কারণ, তা যন্ত্রের মাধ্যমে লব্ধ। এখন আবিষ্কৃত হয়েছে রেডিও টেলিস্কোপ। আমরা তার সাহায্যে অবগত গতে পারছি মহা জগৎ সম্পর্কে।
বিজ্ঞানের দু’টি রূপ আছে। একটিকে বলে বিশুদ্ধ আর অন্যটিকে বলে ফলিত। বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের কাজ নিশ্চিত জ্ঞান অর্জন। আর ফলিত বিজ্ঞানের কাজ হলো সেই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে কিছু বানানো। কিন্তু বিশুদ্ধ আর ফলিত বিজ্ঞানের মধ্যে এই বিভেদ রেখা স্পষ্ট নয়। স্টিম ইঞ্জিনের আবিষ্কার হয়েছে আগে। তাপ গতিবিদ্যার (Thermodynamics) উদ্ভব হয়েছে পরে। বিশুদ্ধ ও ফলিত বিজ্ঞান চলেছে পরস্পরের হাত ধরাধরি করে।
আমরা বলেছি বিজ্ঞান হলো নিশ্চিত জ্ঞান। কিন্তু কথাটা সর্বাংশে যে সত্য, তা নয়। বৈজ্ঞানিকেরা ভুল করেন। কিন্তু সেই ভুল তারা আবার শুধরে নিতেও পারেন। ভুলভ্রান্তি শুধরে নিয়ে বাড়ছে বিজ্ঞানের জ্ঞানের পরিধি। একসময় বিজ্ঞানীরা মনে করতেন ইথার (Ether) আছে। ইথার হলো এমন বস্তু, যার মাধ্যমে তাপ ও আলোর ঢেউরা প্রবাহিত হয়। কিন্তু এখন ইথারের অস্তিত্ব আর স্বীকার করা হয় না। যদিও তাপ ও আলোর ঢেউয়ের অস্তিত্ব এখনো স্বীকার করা হয়। বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য হলো মতবাদিক গোঁড়ামির অভাব। বিজ্ঞানীদের মধ্যে মত নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু এই বিরোধ কখনো সঙ্ঘাতে পরিণত হয় না। একজন বৈজ্ঞানিক আরেকজন বৈজ্ঞানিককে নিধন করবার জন্য পিস্তল উঁচু করে ধরেন না। বাদ প্রতিবাদ চলতে থাকে পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে। বাদ-প্রতিবাদের মধ্য দিয়েই একান্ত গণতান্ত্রিকভাবে বিজ্ঞানীরা কোনো বিষয়ে সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হন।
বিজ্ঞানের স্বরূপ নিয়ে এসব স্থূল কথাগুলো আমার মনে আসছিল। কারণ, অনেককে বলতে শুনছি ব্লগাররা নাকি বিজ্ঞান মনস্ক। কিন্তু ব্লগাররা ঘটাচ্ছেন না বিজ্ঞানের বিকাশ। করছেন না বিজ্ঞানের সাহায্যে এমন কিছুর উদ্ভাবন, যা আমাদের ব্যবহারিক জীবনে কাজে আসতে পারে। এদের প্রধান ল্যবস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে ধর্ম হিসেবে ইসলামের সমালোচনা করা ও ইসলামের নবীকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করা। যা লিখে প্রকাশ করা এখানে সম্ভব নয়। ব্লগাররা নিহত হচ্ছেন তাদের এই উৎকট ইসলাম বিরোধিতার জন্য। তারা কেন এটি করছেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়। কেননা ইসলাম একটি মানবতন্ত্রী ধর্মবিশ্বাস। এবং সমাজের আর্থিক উন্নয়নের পরিপন্থী নয়। ইসলাম একটি অজাগতিক ধর্মবিশ্বাস নয়। ইসলামে বলা হয়েছে, এই পৃথিবীর কাজ দিয়ে বিচার করা হবে কোনো ব্যক্তি যাবে জান্নাতে অথবা জাহান্নামে। কুরআন শরিফে বলা হয়েছে, সৎ ক্রিয়াশীল সব মানুষ জান্নাতে যাবেন। তাদের ভীত হওয়ার কিছু নেই (সূরা- ২: ৬২)। প্রশ্ন ওঠে সৎ বা ভালো কাজ বলতে কী বুঝতে হবে। কুরআন শরিফে বলা হয়েছে, দুর্ভিপীড়িত মানুষকে আহার্যদান হলো উত্তম কাজ (সূরা-৯০:১৪)। কুরআন শরিফে আরো বলা হয়েছে, ধন কেবল ধনীদের মধ্যে সঞ্চালিত হতে দেয়া যাবে না। অসহায় মানুষকে ধনের দ্বারা সাহায্যে করতে হবে (সূরা-৫৯:৭)। ইসলামের নবী তাঁর শেষ বিদায় হজের ভাষণে বলেছিলেন, ‘শ্রমিকের দেহের ঘাম শুকাবার আগেই তার প্রাপ্য মজুরি প্রদান করতে হবে।’ জগতের আর কোনো ধর্ম প্রবর্তক এ রকম কোনো কথা বলেছেন বলে আমার জানা নেই। তবু ব্লগাররা অশ্লীল ভাষায় সমালোচনা করছে ইসলামের নবীকে। এর ফলে ক্ষুব্ধ হচ্ছেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। ব্লগার হত্যা একটা সাধারণ খুনের ঘটনা নয়। এর মূলে আছে আদর্শিক কারণ। মুসলিম আবেগকেও বিবেচনায় নিতে হবে। ব্লগাররা উদ্দেশ্যমূলক মুসলিম জনমতকে ক্ষিপ্ত করে তুলতে চাচ্ছেন। হতে পারে এর মূলে আছে কোনো বিদেশী শক্তির ইন্ধন।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রমেশচন্দ্র মজুমদার মিলনায়তনে বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সঙ্ঘ একটি সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারের বিষয়বস্তু ছিল ‘আক্রান্ত মুক্তবাক : নির্বাক রাষ্ট্র’। এই সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায় বলেছেন, ব্লগার হত্যায় সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন আছে। তিনি এই জন্য সরকারের বিশেষ সমালোচনা করেন (প্রথম আলো : ৪ জুলাই ২০১৫)। আমরা বাইরের লোক। আমরা কোনো রাজনৈতিক দল করি না। কিন্তু বাইরে থেকে যত দূর জানতাম, তা হলো হাসিনা সরকারের সাথে অজয় রায় ও তার সাথীদের আছে হার্দিক সম্পর্ক। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এই সম্পর্কে চিঁড় ধরতে যাচ্ছে। আমরা বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। কিন্তু সেই সাথে আবার এ-ও বিশ্বাস করি যে, মানুষের জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই স্বাধীনতা সীমাহীন হতে পারে না। একটি দেশে বাকস্বাধীনতা যেমন থাকা প্রয়োজন, তেমনি আবার থাকা প্রয়োজন বাকসংযম। না হলে একটা দেশে ক্ষতিকর গৃহযুদ্ধ বেধে যেতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু সেখানেও আছে ব্লাসফেমি আইন। ধর্মের (খ্রিষ্টান) বিরুদ্ধে এমন কিছু বলা যায় না, যাতে সমাজে সঙ্ঘাত সৃষ্টি হতে পারে। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেমন বাকস্বাধীনতা আছে, তেমনি আবার আছে বাকসংযমের ব্যবস্থা। বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপে রাষ্ট্র নয়। এখানে ইসলাম হলো রাষ্ট্রধর্ম। বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট কেবল দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের রক নন, রাষ্ট্রধর্মেরও প্রতিরক (Defender of the faith)। এখানে ইসলামের বিরুদ্ধে যে-কেউ যা কিছু বলে চলবে, তা সংবিধান অনুসারেই হতে পারে না। হাসিনা সরকারের নীতি সম্পর্কে আমরা যথাযথভাবে অবগত নই। কিন্তু হাসিনা যদি ব্লগারদের সমর্থন না করেন, তবে সেটি সংবিধানের পরিপন্থী হবে না। সংবিধান হলো দেশের সর্বোচ্চ আইনের সমষ্টি। সংবিধান দ্বারা একটি দেশ পরিচালিত হয়ে থাকে।
দৈনিক নয়াদিগন্ত/১১ জুলাই ২০১৫