বিখ্যাত ফরাসি নৃতাত্ত্বিক এমিল দুরকেইম (১৮৫৮-১৯১৭) একটি বই লেখেন, Le Suicide (আত্মহত্যা) নামে। তার এই বইটি খুব খ্যাত হয়ে আছে। তিনি তার এই বইতে আত্মহত্যার কারণ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার মতে, ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের মধ্যে আত্মহত্যার হার প্রটেস্টান্ট খ্রিষ্টানদের চেয়ে অনেক কম হতে দেখা যায়। এর কারণ, প্রটেস্টান্ট খ্রিষ্টান ধর্ম ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে প্রতিষ্ঠা লাভের প্রতিযোগিতায় উৎসাহ জোগায়। কোনো ব্যক্তি প্রতিষ্ঠালাভ করতে না পারলে হতে চায় আত্মঘাতী। কিন্তু ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাস মানুষকে এভাবে প্রতিযোগী হতে উৎসাহ দেয় না। তাই ক্যাথলিক সমাজে বিরাজ করে তুলনামূলক শান্তি। আর তাই আত্মহত্যার হারও হতে দেখা যায় কম। কিন্তু অন্যরা তার এই সিদ্ধান্তকে মানতে চান না। তারা বলেন, দুরকেইম গবেষণা করেছেন প্রধানত ফরাসি গ্রাম্য ক্যাথলিক সমাজ নিয়ে। কিন্তু ফরাসি দেশে নগরজীবনে আত্মহত্যার হার যথেষ্ট বেশি। নগরজীবনের সাথে আত্মহত্যার হার বিশেষভাবে জড়িত। দুরকেইম এটার বিচার করেননি।
দুরকেইমের পর আত্মহত্যা নিয়ে গবেষণা করেছেন মার্কিন নৃতাত্ত্বিক রুথ বেনেডিক্ট (Ruth Benedict)। তিনি বলেন, আদিম উপজাতিদের মধ্যে আত্মহত্যার কোনো ধারণা নেই। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Zuni Indians নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেন যে, তাদের ভাষায় আত্মহত্যা বলে কোনো শব্দই নেই। আত্মহত্যা কাকে বলে তা তারা জানে না। নৃতাত্ত্বিকেরা তাই মনে করেন, মানুষ যত সভ্য হয়েছে তত সমাজজীবনে বেড়েছে জটিলতা। আর উদ্ভব হতে পেরেছে আত্মহত্যা। আত্মহত্যা মানুষের কোনো আদিম প্রবৃত্তি নয়। মানুষ বেঁচে থাকতেই চায়। বেঁচে থাকাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষ মারা গেছে প্রধানত জীবাণুজনিত রোগের কারণে। কিন্তু এখন জীবাণুজনিত রোগের কারণে সভ্য জগতে যত না মানুষ মারা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি লোক মারা যায় পথে গাড়িচাপা পড়ে এবং আত্মহত্যা করে।
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ছিল বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, এখন প্রতি বছর বিশ্বে আট লাখ লোক আত্মহত্যা করছে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি লোক আত্মহত্যা করছে ভারতে। ভারতে প্রতি দুই মিনিটে একজন করে মানুষ আত্মহত্যা করে। ভারতে প্রতি বছর বহু কৃষক আত্মহত্যা করে অনাহারে মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য, যা অন্য দেশে করে না। ২০১১ সালে বাংলাদেশে যত লোক আত্মহত্যা করত, এখন তার চেয়ে অনেক বেশি লোক আত্মহত্যা করছে। ২০১১ সালে আত্মহত্যার তালিকায় বাংলাদেশের স্থান ছিল ৩৮তম। কিন্তু এখন তা হয়ে দাঁড়িয়েছে দশম। অর্থাৎ বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার বৃদ্ধি পেয়েছে খুবই আশঙ্কাজনকভাবে। অন্য দেশে আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা হলো বেশি। কিন্তু বাংলাদেশে আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা অনেক বেশি। এর কারণ হিসেবে অনেকে অনুমান করছেন যৌন হয়রানিকে। মেয়েরা হচ্ছে যৌন হয়রানির শিকার। আর সেই লজ্জা ও অপমানে করছে আত্মহত্যা। আমাদের দেশে অবশ্য ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের আত্মহত্যার হার আগেও কিছুটা বেশি ছিল। বাংলাদেশের জেলাগুলোর মধ্যে ঝিনাইদহে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। ঝিনাইদহ জেলায় শৈলকুপা উপজেলায় আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। এখানে মেয়েরা খুব বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ। তাদের এই প্রবণতার ব্যাখ্যা দেয়া যায় না। তবে এটা সৃষ্টি হতে পেরেছে অনেক দিন ধরেই। হঠাৎই এর উদ্ভব হয়নি। বাংলাদেশে কোনো সমাজবিজ্ঞানী অথবা নৃতাত্ত্বিক আত্মহত্যা নিয়ে গবেষণা করছেন কি না আমি তা জানি না। অথচ হওয়া দরকার। কেননা, আত্মহত্যার কারণ সম্পর্কে অবগত হলে আত্মহত্যার হার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। যারা আত্মহত্যা করে তারা কেবল নিজেরাই যে মারা যায় তা নয়। তাদের আত্মীয়-পরিজনও এর ফলে পড়েন মানসিক বিপর্যয়ে। আত্মহত্যা নিবারণ করে এই বিপর্যয়ের মাত্রা কমানো সম্ভবপর হবে। সুখী হতে পারবে সবাই।
আমার মনে পড়ছে কয়েক বছর আগের একটি ঘটনার কথা। আমি পদ্মা নদীর ধারে এক সন্ধ্যায় বসে ছিলাম। এভাবে আমি প্রায় বসে থাকতাম পদ্মা নদীর ধারে। এটা ছিল আমার জীবনরীতি। একদিন একটি বাইশ-তেইশ বছরের মেয়ে ঝাঁপ দেয় পদ্মায়। কিন্তু ঝাঁপ দেয়ার পর সে চিৎকার করতে থাকে বাঁচাও বাঁচাও বলে। আমার কাছে কয়েকজন যুবক বসে ছিল। এদের মধ্যে থেকে দু-তিনজন নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েটিকে রক্ষা করে। পরে পৌঁছে দেয় বাড়িতে।
আমাদের পত্রপত্রিকায় যৌন হয়রানির ঘটনা যেভাবে ছাপানো হচ্ছে, কেবল তাই যদি সত্য হতো, তবে জাতি হিসেবে হয়তো আমরা টিকতাম না। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো এমন যুবক আছে, যারা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে একটা অচেনা মেয়ের প্রাণ রক্ষা করতে পারে এবং দিতে পারে তাকে বাড়িতে পৌঁছে। এরাই জাতির ভরসা।
বিশ্বের নানা দেশে চলেছে এখন আরামে মরণ (Euthanasia) অধিকার আন্দোলন। যার ল্য হলো কোনো মানুষ যদি খুব যন্ত্রণাদায়ক রোগে ভোগে এবং চিকিৎসকেরা বলেন যে, তার রোগ নিরাময় সম্ভব নয়। তবে ওই রোগী যদি চায় সে মরে যাবে, তবে তাকে মরে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এ হলো আরামে মরণ আন্দোলনের ল্য। ইউরোপের নেদারল্যান্ডসে আইন করা হয়েছে যে, যদি দুইজন চিকিৎসক বলেন যে, তাদের রোগী অসম্ভব কষ্ট পাচ্ছে এবং রোগটি চিকিৎসা করে সারানো যাবে না, তবে ওই রোগী তার চিকিৎসককে বলতে পারেন তাকে মেরে ফেলতে। চিকিৎসক যদি তাকে মেরে ফেলেন, তবে তিনি কোনো অপরাধ করবেন না। আমার মনে হয়, এ রকম আইন ধীরে ধীরে অন্য দেশেও প্রবর্তিত হবে। বিলাতে এ রকম আইন করার কথা হয়েছিল। কিন্তু তা এখনো প্রবর্তিত হয়নি। তবে হতে পারে। চিকিৎসকের হাতে মৃত্যু আগুনে পুড়িয়ে আত্মহত্যা কিংবা উদ্বন্ধনে মৃত্যুর চেয়ে অনেক কম কষ্টকর। এটাকে ঠিক তাই আত্মহত্যা বলা চলে না। বলতে হয় চিকিৎসারই অংশ। মানুষকে অহেতুক কষ্ট পেতে না দেয়াই এর লক্ষ্য। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা অবশ্য আরামে মরণ আন্দোলনকে সমর্থন দেয়নি।
আমাদের দেশে আত্মহত্যার একটা বড় কারণ আর্থিক অনটন। আর্থিক সচ্ছলতা আসলে এটা কমে আসবে বলেই মনে হয়। ইসলামে আত্মহনন সমর্থন করা হয়নি। তবু মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে আত্মহত্যার মাত্রা বাড়ছে। অর্থাৎ ধর্মবিশ্বাস এক্ষেত্রে যতটা কার্যকর হওয়া উচিত ছিল, তা হতে পারছে না। সব দেশে ন্যায়নীতির ধারণা এক নয়। বিলাতের আইন অনুসারে আত্মহত্যার চেষ্টা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। ব্রিটিশ শাসন আমলে প্রবর্তিত আইন আমরা এখনো অনুসরণ করছি। তাই আমাদের দেশে আত্মহত্যার চেষ্টাকে অপরাধ বলে গণ্য করা হচ্ছে।
ফরাসি দেশে আত্মহত্যার চেষ্টাকে অপরাধ বলে গণ্য করা হয় না। কেননা, ফ্রান্সে মনে করা হয়, প্রতিটি ব্যক্তি স্বাধীন। সে বাঁচবে না মরবে, সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার। অন্যকে হত্যা করা অপরাধ। কিন্তু নিজেকে হত্যা করা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। কারণ, ব্যক্তি হলো স্বাধীন। অন্য দিকে ব্রিটেনে মনে করা হয়, জীবন পবিত্র। তাকে ধ্বংস করা যেতে পারে না। পাশাপাশি দু’টি দেশের ন্যায় চেতনা যথেষ্ট ভিন্ন। একসময় তাই ইংলিশ চ্যানেল কেউ সাঁতরে পার হতে চাইলে তাকে ফ্রান্সের কোনো বন্দর থেকে সাঁতরানো শুরু করতে হতো। ইংল্যান্ডের কোনো বন্দর থেকে সাঁতরাতে তাকে অনুমতি দেয়া হতো না। কেননা ধরে নেয়া হতো, লোকটা সাঁতরাতে গিয়ে ডুবে যেতে পারে অথবা করতে পারে আত্মহত্যা। আত্মহত্যার চেষ্টা বিলাতের আইনে অপরাধ। কিন্তু বিলাতের আইন বলে, যেকোনো মানুষ বিলাতের জমিতে সাঁতরে উঠতে পারে। সেটা কোনো দণ্ডনীয় অপরাধ নয়। কেননা জাহাজডুবির সময় নাবিকেরা যেকোনো দেশের জমিতে বিনা অনুমতিতে প্রাণ বাঁচানোর জন্য সাঁতরে উঠতে পারে। তাই ফ্রান্স থেকে সাঁতরে বিলাতে যেতে কোনো বাধা ছিল না। বাংলাদেশের ব্রজেন দাস ১৯৫৮ সালে ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরে পার হন। তিনি সাঁতরানো শুরু করেন ফ্রান্সের উপকূল থেকে। আমরা এসব কথা বলছি কেবল এই টুকু বোঝাতে যে, ন্যায় অন্যায়ের ধারণা সব দেশের এক নয়। আর সেটা যে শাশ্বত, তা-ও নয়। আরামে মরণ আন্দোলন তাই অনেক দেশেই সাফল্য পেতে পারে।
অনেক সময় দেখা যায় যে, কেউ আত্মহত্যা করতে গিয়ে সে বাঁচতে চাচ্ছে। আমরা উল্লেখ করেছি একটি মেয়ের নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর বাঁচবার আকুতির কথা। আত্মহত্যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হলো একটা আবেগগত ব্যাপার; যা ক্ষণস্থায়ী। তাই কেউ আত্মহত্যা করতে চাইলে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করা শ্রেয়। কেননা সে পরে শান্ত হয়ে সুখী জীবনের অধিকারী হতে পারে।
একসময় শিক্ষকতা করতাম। অনেক ছাত্র পরীক্ষায় সফল হতে না পেরে চেয়েছে আত্মহত্যা করতে। কিন্তু তারা অনেকেই পরে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে জীবনে। পরীক্ষায় পাস করতে না পারলেই জীবন বিফল হয়ে যায়, এমন ভাবা বিশেষভাবেই বেকুবি। বন্ধুবান্ধব ও অত্মীয়-পরিজন এ রকম বেকুবির হাত থেকে অনেককেই বাঁচিয়েছেন এবং বাঁচাচ্ছেন। অনেক সময় দেখা যায় প্রেমে বিফল হয়ে লোকে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু যদি তারা বেঁচে থাকে তবে তারা পারে সুখে ঘরসংসার করতে। কেননা, এই পৃথিবীতে একজন পুরুষ একজন নারীর জন্য জন্মায় না; অথবা একজন নারী, একজন পুরুষের জন্য জন্মায় না। অচেনা নারী পুরুষ বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সুখী হতে পারে। এ রকম দৃষ্টান্তের কোনো অভাব নেই। রোমান্টিক ভালোবাসার ধারণা কয়েক শ’ বছর আগে কোনো দেশেই বলতে গেলে ছিল না। ভালোবাসার কাহিনী প্রধানত সীমাবদ্ধ থেকেছে রাজপুত্র ও রাজকন্যার মধ্যে। থেকেছে রূপকথার রাজ্যে।
একদিন খুব সকালে হঠাৎ আমার দরজার কড়া নড়ে ওঠে। দরজা খুলে দেখতে পাই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীকে। তাকে মুখ চিনতাম। কিন্তু ভালো করে চিনতাম না। সে আমাকে বলে যে, সে কিছু ব্যক্তিগত কথা আমাকে বলতে চায়। আমি তাকে ঘরে এসে বসতে বলি। সে যা বলে, তা হলো, সে একজন প্রভাষককে বিয়ে করতে ইচ্ছুক। কিন্তু প্রভাষক তাকে বিয়ে করতে রাজি নন। আমি এ ব্যাপারে কোনো মধ্যস্থতা করতে পারি কি না। কেননা, ওই প্রভাষক আমাকে খুব শ্রদ্ধা করেন। তাই আমার কথা তিনি শুনলেও শুনতে পারেন। মেয়েটিকে খুব আবেগপ্রবণ মনে হলো। আমি তাকে অনেক বুঝিয়ে বলি যে, ভালোবাসা ব্যাপারটা একপাক্ষিক নয়। আর কোনো তৃতীয় ব্যক্তি এতে সহযোগিতাও করতে পারে না। মেয়েটি কাঁদতে শুরু করে। যা হোক, আমি পরিস্থিতিটা কোনোমতে সামাল দিই। পরে মেয়েটির বিয়ে হয়েছিল মা-বাবার ইচ্ছায় একটি অপরিচিত ছেলের সাথে। মেয়েটি সংসারে সুখী হয়েছিল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দিয়েই গেছে রেলের লাইন। দু-একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শোনা যায় ভালোবাসায় বিফল হয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করার কথা। আমি মনে করি, তারা যদি এভাবে না মরত তবে অন্য কোনো পুরুষকে বিয়ে করে হতে পারত সংসারী। কথায় বলে, স্নেহ অধঃমুখী। নর-নারীর বন্ধন সুদৃঢ় হয় ছেলে মেয়েকে যৌথভাবে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে। যেখানে এটার অভাব ঘটে সেখানে দেখা যায় পারিবারিক বন্ধনের ভাঙন। আমাদের দেশে এখন নারী স্বাধীনতার কথা বিশেষভাবে প্রচার পাচ্ছে। অনেক নারী এই স্বাধীনতার হুজুগে হচ্ছে বিপথগামী। হতে পারছে না জীবনে সুখী। এদের অনেকে বেছে নিচ্ছে আত্মহননের পথ। আমার মনে হয় বাংলাদেশে মেয়েদের আত্মহত্যার হার বৃদ্ধির এটাও একটা কারণ। জীবনে সুখী হতে হলে দু’জনের প্রয়োজন হয়। দু’জনকেই মানিয়ে নিতে হয় দুজনের সঙ্গে।
দৈনিক নয়াদিগন্ত/২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫