(১ম পর্ব)
সেটা প্রায় ১০-১২ বছর আগেকার ঘটনা। একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত কলামের শিরোনামে চোখ আটকে গেল। একটানে পড়া সেই পুরো লেখাটির প্রতিটি লাইনে তদানীন্তন একটি আলোচিত রাজনৈতিক ঘটনার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে একেবারে সাম্প্রতিক বিবরণ অনেকটা অনুসন্ধানী রীতিতে তুলে ধরা হয়েছিল। লেখার ছত্রে ছত্রে গ্রহণযোগ্য বহু খ্যাতনামা ইতিহাসবিদের রেফারেন্স এবং লেখকের নিজস্ব বিশ্লেষণধর্মী মূল্যায়ন ছিল এককথায় মুগ্ধতা জাগানিয়া। ‘আত্মপক্ষ’ নামের সেই কলামের পাশে ছাপানো ছিল একজন বয়োবৃদ্ধ লেখকের ছবি, দেখে মনে হলো যেন ইতিহাস ও দর্শনের গভীরে ডুব দেওয়া নিমগ্ন এক সাধকের প্রতিবিম্ব। প্রথম পড়া সেই লেখার পর থেকেই পত্রিকাটিতে লেখকের কলাম নিয়মিত পড়া শুরু হলো। প্রতি সপ্তাহে প্রকাশিত কলামগুলোতে বিষয়বস্তুর বিপুল বৈচিত্রের সম্ভার দেখে লেখককে একেকসময় ইতিহাসবিদ, শিক্ষক, বিজ্ঞান লেখক, সাহিত্যিক, দার্শনিক, শিল্প সমালোচক বা স্থপতি ভেবে ভ্রম হতে লাগলো। একের পর এক প্রকাশিত দুর্দান্ত সব লেখনী পড়ে লেখকের সম্পর্কে বিস্তারিত জানার তীব্র আগ্রহ তৈরী হলো। মাত্র দুটি শব্দ ‘শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট’ পরিচয়ে দেওয়া সেই লেখকের নাম এবনে গোলাম সামাদ। পুরাতন লেখা, বইপত্র ও ইন্টারনেট ঘেটে লোকটি সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যাচ্ছিল না। তবে বৃটিশ শাসনামলের একেবারে শেষভাগ, পাকিস্তান আন্দোলন, ভারত ভাগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় সহ গত শতাব্দীতে এই উপমহাদেশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাবলী নিয়ে বেশকিছু লেখায় লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং ঘটনার পরিক্রমায় বহু বিখ্যাতজনের সঙ্গে উনার সরাসরি সম্পৃক্ততা ও পরিচয়ের প্রাসঙ্গিক বিবরণ লেখক সম্পর্কে জানার আগ্রহটা একেবারে তুঙ্গে নিয়ে গেল। ২০১৪ সালে প্রকাশিত সমকালীন একজন জাতীয় রাজনীতিবিদের লেখা ‘অবরুদ্ধ দিনলিপি’ নামক বইতে সন্নিবেশিত বেশকিছু তথ্য থেকে জানতে পারলাম লেখক এবনে গোলাম সামাদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিখ্যাত একজন অধ্যাপক। ভেবে আশ্চর্য হলাম যে, বিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক কীভাবে এতো বৈচিত্রপূর্ণ বিষয়াবলীতে চমকপ্রদ ঝরঝরে গদ্যে বিশ্লেষণধর্মী অসাধারণ সব কলাম লিখেন। বইটির লেখক উনাকে ‘রাজশাহীর সক্রেটিস’ নামে সম্বোধন করে লিখেছেন যে, নিরহংকারী এবং নিঃস্বার্থ এক জ্ঞানতাপস ডঃ এবনে গোলাম সামাদ রাজশাহীতেই বসবাস করেন। পরবর্তীতে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত আরেকটি লেখায় সাহিত্যিক এবং ব্যাকরণবিদ হায়াত মামুদ করেন উনার বেশকিছুটা প্রশংসা। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, যে করেই হোক ব্রিটিশ ভারত, তদানীন্তন পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশের বহু ইতিহাসের চাক্ষুষ স্বাক্ষী এই ত্রিকালদর্শী লেখকের সঙ্গে দেখা করতেই হবে। অনেক চেষ্টা ও সাধনার পর ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো প্রফেসর ডঃ এবনে গোলাম সামাদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাতের সুযোগ ঘটে। পরবর্তীতে ২০২০ সাল পর্যন্ত আরও তিনবার বয়োবৃদ্ধ এই অধ্যাপকের সঙ্গে সাক্ষাতের দুর্লভ সুযোগে জানতে পেরেছিলাম বহু অজানা ইতিহাস এবং ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে। দীর্ঘ আলাপচারিতায় তথ্য ও জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি আবিষ্কার করতে পেরেছিলাম একজন লেখক কতটা প্রচারবিমুখ, নির্লোভ, নিঃস্বার্থ এবং দেশপ্রেমে মশগুল হতে পারেন। ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট ৯২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন ডঃ এবনে গোলাম সামাদ। আজকের এই লেখাটি মহাপ্রাণ সেই মানুষটির স্মৃতিচারণামূলক। এই লেখার শৈলীতে অনেকটা জুড়ে থাকবে প্রফেসর সামাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা ও স্মৃতির রোমন্থন।
লেখকের প্রাথমিক পরিচয়:
১৯২৯ সালের ১৪ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশন। ঐ বছরই স্টেশনটির দ্বিতীয় স্টেশন মাস্টার হিসেবে যোগ দেন মোঃ ইয়াসিন আলী। সেই বছরের ২৯ ডিসেম্বর তার স্ত্রী নসিরন নেসার গর্ভে জন্ম নেন সর্বকনিষ্ঠ পুত্রসন্তান এবনে গোলাম সামাদ। পিতার লেখালেখির চর্চায় অনুপ্রাণিত হয়ে এবনে গোলাম সামাদের ভাইবোনদের সকলেই কমবেশি লেখালেখির চর্চাটা করতেন। এক আলাপচারিতায় প্রফেসর সামাদ জানান, তার পিতার লেখা একাধিক বই ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। কিন্তু বেশ পীড়াপীড়ি করার পরেও তিনি স্বভাবজাত প্রচারবিমুখিতার কারণে বইগুলোর নাম বা বিস্তারিত কিছু জানাননি। তার এক বোন দৌলতুন্নেসা ছিলেন লেখিকা এবং বেশ নামকরা রাজনীতিবিদ। মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সময় সক্রিয় অংশগ্রহণ করে গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেছিলেন তার এই বোন। পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের এমএলএ নির্বাচিত হন। বোন দৌলতুন্নেসার রাজনৈতিক প্রচারণার কার্যক্রমে যুক্ত থাকার বদৌলতে এবনে গোলাম সামাদ আসতে পেরেছিলেন বিখ্যাত সব রাজনীতিবিদদের সান্নিধ্যে। খুব কাছে থেকে দেখতে পেরেছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মতো আরও অনেক খ্যাতনামা রাজনীতিবিদদের। কৈশোরে একদিন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার যদুনাথ সরকারের বাড়িতে ঘুরতে যান এবনে গোলাম সামাদ। সেখানে উনার বাসার লাইব্রেরিতে দেখতে পান বিপুল বইয়ের সংগ্রহ। বিষয়টি তার অনুসন্ধিৎসু কিশোর মনে জ্ঞানপিপাসার ব্যাপক উদ্দীপনা তৈরী করে। অনেক ছোটবেলা থেকেই নিজ বাসাতে বহুবিধ বিষয়ের অনেক বইপত্র হাতের কাছে পেতেন এবং পড়তেন তিনি। এই পড়া এবং লেখার অভ্যাসটি সেই সময় থেকেই তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায় যা অব্যাহত ছিল জীবনের একেবারে শেষলগ্ন পর্যন্ত। তার পিতা ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এবনে গোলাম সামাদ পেরেছিলেন পিতার সেই আকাঙ্খার যথাযথ প্রতিদান দিতে। ১৯৪৮ সালে চব্বিশ পরগণার বিষ্ণুপুর শিক্ষা সংঘ থেকে মেট্রিক সমমান পরীক্ষায় পাশ করে তিনি ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ছিল পূর্ববঙ্গের তৃতীয় প্রাচীনতম কলেজ। ১৯৪৯ সালে এই কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকার তেজগাঁও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বর্তমান শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে কৃষি ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এরপর পিতার স্বপ্নপূরণে বিলাতে গমন করেন তিনি। বিলাতের সুবিখ্যাত লিডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৪ সালে উদ্ভিদের রোগতত্ত্ব বিষয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন তিনি। দেশে ফিরে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে কিছুদিন চাকরি করেন তিনি। এই সময় নিজ উদ্যোগে ফরাসী ভাষার উপর একটি ডিপ্লোমা অর্জন করেন এবনে গোলাম সামাদ। ১৯৫৯ সালে ফরাসী সরকার কর্তৃক প্রাপ্ত বৃত্তি নিয়ে প্যারিসে গমন করেন তিনি। সেখানকার পুয়াতিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর গবেষণার পর ১৯৬৩ সালে উদ্ভিদের জীবানুতত্ত্ব বিষয়ে পিএচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। সম্পূর্ণ ফরাসী ভাষায় লেখা তার অভিসন্দর্ভটি প্রকাশিত হয়। দেশে ফিরে এসে ১৯৬৫ সালের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি। তার শিক্ষাজীবনের তিনটি স্তর গভীর প্রভাব ফেলে তার চিন্তাচেতনা ও ব্যক্তিগত জীবনে। এবনে গোলাম সামাদ রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় প্রায়ই বিভিন্ন মিছিল-মিটিং এবং সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতো। অনেক বিখ্যাত রাজনীতিবিদ এবং বিদ্বজ্জন সেই সভা-সমাবেশে বক্তৃতা করতেন। তিনি সেই সভাগুলোতে গিয়ে গভীর মনোযোগে বক্তৃতা শুনতেন এবং সেই সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাবলীকে পর্যবেক্ষণ করতেন। হাইস্কুলের উচ্চশ্রেণিতে পড়ার সময় সরাসরি দেখেছেন বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামের উত্তুঙ্গ মুহূর্তগুলো। রাজশাহী শহর ছিল সে সময় রাজনৈতিকভাবে খুব সরব অঞ্চল। তাই ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পূর্বাপর রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী তিনি হতে পেরেছিলেন পুরোদস্তুর রাজনীতি সচেতনতা নিয়ে।
বিলাত ও ফরাসী দেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনের সময় এবনে গোলাম সামাদ সেসব দেশের বিখ্যাত সব লাইব্রেরিতে অধ্যয়ন করেছেন প্রচুর বইপত্র। তদানীন্তন বাংলাদেশে দুষ্প্রাপ্য এসব বইপত্র, ম্যাগাজিন ও দলিল-দস্তাবেজ অধ্যয়ন তার চিন্তা ও বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ার পরিকাঠামো গঠনে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ইউরোপের জীবনযাত্রা ও কৃষ্টি-কালচার চাক্ষুষ অবলোকনের পাশাপাশি সেসব দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও চর্চা তিনি দেখেছেন গভীর অভিনিবেশে। নিজের ছাত্রাবস্থায় উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম এবং তাদের শাসনের অবসান ঘটলেও ব্রিটিশ এম্পিরিসিজম (British Empiricism) তথা অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানবাদের চর্চা দ্বারা ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ হন তিনি। তিনি বিশ্বাস করতেন, জড়ের নিয়ম দ্বারা জীবন্ত সত্ত্বার সবকিছু ব্যাখ্যা করা যায় না। আর শুধুমাত্র যুক্তি বা তত্ত্ব দিয়েও সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ সম্ভব নয়, প্রয়োজন বাস্তব জ্ঞানের। তবে ব্রিটিশ ভাবাদর্শে উজ্জীবিত হলেও তিনি চালচলন, জীবনযাপন ও বৈষয়িক ক্রিয়াকলাপে সাহেব হতে চাননি একেবারেই। সবরকম সুযোগ থাকা সত্ত্বেও স্থায়ী হননি ফরাসী দেশে। অনুভব করেছেন দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি তীব্র টান। তিনি সবসময় বলতেন, রাজশাহীতে জন্ম, বেড়ে উঠা এবং প্রায় সম্পূর্ণ কর্মজীবন এখানে অতিবাহিত করায় এই শহরের পরিমণ্ডলকে বাদ দিয়ে তার চিন্তাজগতের মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। এই শহর, দেশ ও ইতিহাসের প্রতি দায় আছে তার। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় রাজশাহী শহরে পিতার হাত ধরে প্রত্যক্ষ করেছেন হাড় জিরজিরে মরণাপন্ন মানুষের আস্তাকুঁড়ের ময়লা খেয়ে বেঁচে থাকার প্রাণান্তকর শেষচেষ্টা। সেই সময়েই জীবনে পরিশ্রম করা এবং উপার্জনের নিরাপদ পথ তৈরী করার প্রয়োজনীয়তার সবক পেয়েছিলেন পিতার কাছ থেকে। বিষয়গুলো গভীর রেখাপাত করেছিল এবনে গোলাম সামাদের গোটা জীবন জুড়ে। মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি সমবেদনা বোধ এবং কল্যাণচিন্তা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাকে সারাজীবন ভাবতে বাধ্য করেছে। সেই তাড়না থেকেই তিনি পাঠ করেছেন বিষয়বস্তুর বৈচিত্রে ভরপুর বিপুল সংখ্যক বইপত্র ও লেখালেখি। সবসময় সচেষ্ট থেকেছেন সর্বশেষ বিশ্ব পরিস্থিতি, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বিজ্ঞান, সমাজনীতি সহ বহুবিধ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ এবং নিজস্ব পাঠ ও বিশ্লেষণ রীতিতে সেইসব ঘটনাবলীকে ব্যাখ্যা করতে। অর্জিত জ্ঞান ও চিন্তাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য হাতে তুলে নিয়েছেন কলম, লিখেছেন জীবনের অন্তিম সময় অব্দি।
লেখকঃ হৃদ্য মোহাম্মদ।