‘হিন্দুত্ব’ কথাটার আভিধানিক অর্থ হলো হিন্দু ধর্মানুযায়ী ভাব। কিন্তু এই উপমহাদেশে এর বাস্তব অর্থ দাঁড়িয়েছে মুসলিম-বিদ্বেষকে পুঁজি করে রাজনীতি করা। চাকমারা নিজেদের দাবি করেন বৌদ্ধ হিসেবে। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তারা হলেন হিন্দু মনোভাবাপন্ন। তাদের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা উদ্ভূত হতে পেরেছে ও পারছে হিন্দুত্ব থেকে। চাকমারা নিজেদের বৌদ্ধ বলে দাবি করলেও তারা করছেন নানা হিন্দু দেব-দেবীর পূজা। এদের মধ্যে আছেন হিন্দু দেবী লক্ষ্মী, আছেন দেবী কালী। তবে হিন্দুদের থেকে চাকমাদের হিন্দু দেবদেবী পূজার রকম হতে পেরেছে বেশ কিছুটা ভিন্ন। ১৯০১ সালের আদমশুমারির রিপোর্টে বলা হয়েছে চাকমারা লক্ষ্মী পূজা করেন। কিন্তু লক্ষ্মী তাদের কাছে হলেন ফসলের দেবী। তারা লক্ষ্মীপূজা করেন ফসলের ফলন বৃদ্ধির লক্ষ্যে। তারা লক্ষ্মীর কোনো মূর্তি গড়ে পূজা করেন না। লক্ষ্মীপূজার জন্য একটি পৃথক ঘরে একটি প্রস্তরখণ্ড স্থাপন করেন। লক্ষ্মীপূজার সময় এই পাথরের বেদিতে মুরগি, শূকর ইত্যাদি প্রাণী বলি দেন। পরে তারা এই বলিপ্রদত্ত প্রাণীদের মাংস রান্না করে পালন করেন মহাভোজ উৎসব।
জে ডি এন্ডারসন (J. D. Anderson) একসময় ছিলেন ব্রিটিশ আমলের চট্টগ্রাম জেলার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি বাংলা ও আসাম প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে চাকরি করেন। বাংলা ভাষার ওপর তার ছিল গভীর টান। তিনি এই ভাষা শেখেন যথেষ্ট আগ্রহ ও মনোযোগ দিয়ে। শেষ বয়সে তিনি হন বিলাতের বিখ্যাত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা সাহিত্যের অধ্যাপক। তিনি একটি বই লেখেন The Peoples of India নামে। এই বইয়ের এক জায়গায় (পৃষ্ঠা-৮) চাকমাদের সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, চাকমারা হলেন তিব্বতি-বর্মি (Tibeto-Burman) মানবধারার লোক। কিন্তু তারা অংশত হয়ে পড়েছেন হিন্দু (Partly Hinduised)। চাকমারা বাস করেন বাংলা প্রদেশের পূর্ব প্রান্তে। চাকমারা আধা হিন্দু। এ কথা বলেছেন এন্ডারসন। এন্ডারসনের এই বক্তব্যকে ভিত্তি করে চাকমাদের বিচার করলে চাকমা রাজনীতির বর্তমান ধারাকে বোঝা হয়ে ওঠে সহজ। চাকমারা হিন্দু মনোভাবাপন্ন এটা আমরা বলছি না। একাধিক ব্রিটিশ পর্যবেক্ষকও করেছেন এই বিষয়ে একই রকম মন্তব্য। কেবল আমরা (বাংলাভাষী মুসলমান) এ রকম মন্তব্য করলে উঠতে পারত মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এই সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ ওঠা সম্ভব নয়। চাকমারা কেন হিন্দুভাবাপন্ন হয়েছেন সেটার ব্যাখ্যা করা সহজ নয়। কারণ তারা একসময়ে ঠিক হিন্দুভাবাপন্ন ছিলেন না।
চাকমাদের সম্পর্কে একটা খুব নির্ভরযোগ্য বই লেখেন শ্রী সতীশচন্দ্র ঘোষ। বইটির নাম ‘চাকমা জাতি’। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯০৯ সালে। বইটিতে তিনি বলেছেন (পৃষ্ঠা ৬), একসময় চাকমা ভূপতিরা নিজেদের নাম রাখতেন মুসলমানি প্রথায়। যেমন জামুল খাঁ, শেরমুস্ত খাঁ, শের দৌলত খাঁ, জানবক্স খাঁ, টব্বর খাঁ, ধর্মবক্স খাঁ প্রভৃতি। চাকমা ভূপতিদের স্ত্রীরা তাদের নামের আগে বিবি সম্বোধন যোগ করতেন। চাকমারা খেদ অথবা বিস্ময়ের আবেগ প্রকাশের সময় বলতেন খোদা। একে অপরের সাথে দেখা হলে দিতেন সালাম। কেন কী কারণে চাকমারা পরে হিন্দু মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠতে পারলেন সেটার ব্যাখ্যা এখনো কেউ করার চেষ্টা করেননি। তবে অনুমান করা চলে, চাকমারা বিশেষভাবে হিন্দু মনোভাবাপন্ন হয়ে ওঠেন ব্রিটিশ শাসনামলে; তার আগে নয়।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, একসময় আরাকানের রাজারা ছিলেন গৌড়ের সুলতানদের সামন্ত। আরাকানের রাজারাও রাখতেন মুসলমানি কায়দায় নাম। এমনকি তাদের মুদ্রিত মুদ্রায় উৎকীর্ণ করেছেন কালেমা তাইয়্যেবা। সম্ভবত আরাকান রাজাদের একটা প্রভাব এসে পড়তে পেরেছিল চাকমা ভূপতিদের ওপর।
সতীশচন্দ্র ঘোষের মতে, চাকমা নামটা এসেছে ব্রহ্মদেশীয় ‘ছাক’ অথবা ‘ছেক’ নাম থেকে। বর্মি (ম্রনমা) ভাষায় চাকমাদের এই নামে ডাকা হয়। ছাক থেকে হয়েছে ছাকমা। আর ছাকমা থেকে হয়েছে চাকমা। ব্রিটিশ নৃতাত্ত্বিক রিজলে চাকমা নামের উদ্ভব সম্পর্কে একই মত প্রকাশ করেছেন। কথাগুলো বলতে হচ্ছে এই কারণে যে, বর্তমানে প্রচার করা হচ্ছে চাকমা নামটি সৃষ্টি হতে পেরেছে সংস্কৃত ‘শক্তিমান’ শব্দ থেকে। এই শক্তিমান নামটি নাকি প্রদান করেছিলেন মিয়ানমারের কোনো রাজা। কিন্তু মিয়ানমারের রাজা কেন সংস্কৃত নাম দিতে যাবেন তা বোঝা দুষ্কর। কারণ বর্মি বা ম্রনমা ভাষা হলো তিব্বতি-চীনা ভাষা পরিবারভুক্ত। ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের সাথে তার (বর্মি ভাষার) সুদূর যোগাযোগ কল্পনা করা যায় না। কিন্তু ভারত থেকে এখন প্রচার করা হচ্ছে, চাকমা নামটি হলো সংস্কৃত ভাষা থেকে আসা। ‘শক্তিমান’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ক্ষমতাসম্পন্ন। বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে, চাকমারা হলেন ক্ষমতাধর জাতি। এটা একটা বিশেষ রাজনৈতিক অভিসন্ধি। মানবধারার দিক থেকে চাকমারা হলেন মঙ্গলীয় শাখাভুক্ত। এটা তাদের চেহারা দেখে সহজেই অনুমান করা যায়। তাদের কোনোভাবেই ‘আর্য’ বলা যায় না।
চাকমারা দাবি করছেন, তাদের পূর্বপুরুষ চম্পা নগর থেকে এসে উপনিবিষ্ট হন চট্টগ্রামে। তারা আসলে আর্য বংশোদ্ভব। চম্পা নগর ছিল বর্তমান বিহারের মগধ অঞ্চলের কোনো স্থানে অবস্থিত। কিন্তু এর কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে বলে মনে হয় না। বিহারের মগধ অঞ্চলের মানুষের চেহারা চাকমাদের মতো মোটেও মঙ্গলীয় নয়। বিহারের মানুষের সাথে চাকমাদের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আসলে চাকমাদের ইতিহাস সম্পর্কে আমরা বিষয়গতভাবে এখনো খুব বেশি কিছু জানি না। ব্রিটিশ শাসনামলে আর এইচ হাসিনসন (R. H. Hutchinson) সঙ্কলন করেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার গেজেটিয়ার। যা প্রকাশিত হয় ১৯০৯ সালে। এতে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার মানুষের ইতিহাস সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে অনুমান করা যেতে পারে ‘ম্রো’ ও ‘কুকিরা’ প্রথমে এসে এখানে বসতি করেছিলেন। চাকমারা প্রথমে এসে বসতি করেছিলেন চট্টগ্রাম জেলার (সাবেক) মধ্যভাগে ম্রো ও কুকিদের সরিয়ে দিয়ে। ম্রো ও কুকিরা সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে উপনিবিষ্ট হয়েছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার উত্তর-পূর্বভাগে। পরে বার্মা যুদ্ধের সময় মগরা (যাদের এখন আমরা বলছি মারমা) এসে উপনিবিষ্ট হতে থাকেন চট্টগ্রামে। মগরা এসে চাকমাদের বিতাড়িত করেন। চাকমারা বাধ্য হয় রাঙ্গামাটির গভীর বনাঞ্চলের বাসিন্দা হতে। চাকমারা, এই বর্ণনা সত্যি হলে বলতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নয়। চাকমাদের সম্পর্কে আমাদের মনে নানা ভুল ধারণা সঞ্চিত হয়ে আছে। যেমন আমরা মনে করি, চাকমাদের জীবনধারা বহন করছে নব্যপ্রস্তর যুগের ঐতিহ্য। জুমচাষ হলো খুবই প্রাচীন চাষপদ্ধতি। চাকমারা করেন জুমচাষ।
আমি ১৯৫২ সালে একবার রাঙ্গামাটি বেড়াতে গিয়েছিলাম। এ সময় দেখেছি চাকমা জুমচাষিরা বনের গাছ কাটছেন লোহার দা দিয়ে। বনে গাছ কাটার পর জুমচাষিরা ওই সব গাছকে ক’দিন ধরে রোদে শুকাতে দেন। তারপর ওই সব কাটা গাছে ধরান আগুন। আগুন ধরিয়ে তারা বের করেন জমি। তারপর জমিতে গর্ত করে বপন করেন বীজ। তারা জমিতে গর্ত করেন লোহার দা দিয়ে। জুমচাষ খুব প্রাচীন চাষপদ্ধতি। অনেক নৃতাত্ত্বিক এ সম্পর্কে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কারো কারো মতে, নব্যপ্রস্তর যুগে মানুষ বনের গাছ কেটেছে পাথরের কুড়াল দিয়ে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে কোনো পাথরের তৈরি কুড়ালের অস্তিত্ব কোনো দিন ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা ও অন্য উপজাতিরা বনের গাছ কেটেছেন লোহার দা দিয়ে। অর্থাৎ তাদের বলতে হয় আমাদের মতোই লৌহযুগের মানুষ।
চাকমা ও অন্যান্য পার্বত্য উপজাতির মধ্যে অবশ্য কোনো লোহার কামার নেই। কামারেরা সবাই হলেন বাঙালি। কিন্তু বাঙালি কামারেরা গিয়ে তাদের কর্মশালা খুলেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের নানা জায়গার হাটবাজারে। তারা হয়ে উঠেছেন উপজাতি সমাজের অংশ। অন্য দিক থেকেও পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীকে বলা যেতে পারে না আদিম সমাজভুক্ত। তাদের মধ্যে সরদার প্রথা ছিল, কিন্তু ব্রিটিশ শাসনামলে তাদের মেনে চলতে হয়েছে রাষ্ট্রিক আইন। অবশ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় বিচার পদ্ধতি ছিল অন্য জেলা থেকে ভিন্ন। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচার করতেন ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার। তিনি বিচারক ছিলেন ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার। পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসনামলে একমাত্র খুনের মামলা ছাড়া আর কোনো মামলায় পেশাদার উকিল নিযুক্ত করা যেত না। কিন্তু ডিস্ট্রিক্ট কমিশনারের রায়ের বিপক্ষে হাইকোর্টে মামলা করা যেত। সেখানে ভূমিসংক্রান্ত মামলাতে নিযুক্ত করা যেত উকিল। এই সব কথা বলতে হচ্ছে এ জন্য যে, এখন দাবি করা হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ব্রিটিশ শাসনামলে কোনো রাষ্ট্রিক আইনের দ্বারা পরিচালিত হতো না। পরিচালিত হতো প্রথাগত উপজাতি আইনের দ্বারা। কিন্তু এটা সত্য নয়। ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল হাইকোর্টের এখতিয়ারভুক্ত। হাইকোর্ট পারত পার্বত্য চট্টগ্রামে আইন বলবত করতে।
আমরা বলেছি, চাকমারা মনোভাবের দিক থেকে হলেন হিন্দুভাবাপন্ন। আমরা মনে করি, তাদের রাজনীতি পরিচালিত হতে পারছে হিন্দুপ্রবণতা দিয়ে। এ ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা বিশদ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করি। যেটা করতে গিয়ে বলা প্রয়োজন, ব্রিটিশ আমলের রাজনীতি নিয়ে কিছু কথা। ব্রিটিশ আমলে হিন্দুদের মধ্যে যে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে, সেটা ছিল হিন্দুত্ববাদী। এই জাতীয় চেতনার প্রথম প্রকাশ আমরা দেখতে পাই বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে। বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে আছে বন্দে মাতরম গানটি। এই গান হলো বিশেষভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদী। এই গান একদিন হয়ে উঠেছে ভারতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক চেতনার মূল উৎস। যার সাথে এ উপমহাদেশের মুসলমানেরা কোনোভাবেই একাত্ম হতে পারেনি। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বন্দে মাতরম গানটির সুর বঙ্কিমচন্দ্র দেননি। সুর দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর, ভারতের রাষ্ট্র গঠন পরিষদ (The Constituent Assembly) ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রস্তাব গ্রহণ করে, ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হবে দু’টি। একটি হলো বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দে মাতরম, অপরটি হলো রবীন্দ্রনাথের জনগণমন। এখন রবীন্দ্রনাথের জনগণমন গানটি গীত হচ্ছে বেশি। কিন্তু তা বলে বন্দে মাতরম বাদ পড়ে যায়নি। আসলে ভারতের হিন্দু রাজনীতি পরিচালিত হচ্ছে হিন্দুত্ব দিয়ে। আর বন্দে মাতরম হচ্ছে তার উৎস।
১৯০৫ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত এই পঁচিশ বছর ধরে ব্রিটিশ বাংলায় চলেছে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন। সন্ত্রাসবাদীরা মনে করেছেন, নিয়মতান্ত্রিক পথে আন্দোলন করে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানো যাবে না। করতে হবে বল প্রয়োগ। করতে হবে সাহেব কর্মচারীদের খুন। সৃষ্টি করতে হবে আতঙ্কের পরিবেশ, যা ভেঙে দেবে ব্রিটিশ মনোবল। আর এ দেশে বিলুপ্তি ঘটাবে তাদের শাসনের। চট্টগ্রাম শহর হয়ে উঠেছিল সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। চট্টগ্রামের সন্ত্রাসবাদী দলের সদস্যরা ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল ৯টা ৪৫ মিনিটে করেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন। যা এই উপমহাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। চট্টগ্রামের ঘটনার প্রভাব নিশ্চয়ই কিছু পরিমাণে রাঙ্গামাটিতে গিয়ে পৌঁছেছিল। বর্তমান চাকমা নেতারা চট্টগ্রাম শহরের সন্ত্রাসবাদী অভ্যুত্থানের কাহিনী শ্রবণ করেছেন তাদের জ্যেষ্ঠদের কাছে। আর প্রভাবিত হয়েছেন সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের ধ্যানধারণার দ্বারা। চাকমাদের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনাকে উপলব্ধি করতে হলে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের ইতিহাসকে মনে রাখতে হয়।
সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা এখন আর বিশেষভাবে আলোচিত হয় না। কিন্তু আলোচিত হওয়া প্রয়োজন। সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ছিল। কিন্তু এর সাথে মুসলমানদের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। হিন্দু সন্ত্রাসবাদীরা মুসলমানদের করতেন ঘৃণা। তারা মুসলমানদের গ্রহণ করেননি তাদের দলে। সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন সম্পর্কে ভারতের এক কালের বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা মোজাফফর আহমদ তার আত্মজীবনী ‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ গ্রন্থে বলেছেন (ঢাকা সংস্করণ ১৯৭৭, পৃষ্ঠা ১০) বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলন নিঃসন্দেহে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ছিল। কিন্তু তা হিন্দু উত্থানের আন্দোলনও ছিল। উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু রাজত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা।’ মোজাফফর আহমদ আরো বলেছেন, সন্ত্রাসবাদীরা জেলে গিয়ে তাদের কারাকক্ষে টাঙাতেন মা কালীর ছবি। তারা মনে করতেন, মা কালী হলো শক্তিপ্রদায়ী দেবী। মা কালী প্রদান করবেন তাদের ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে শক্তি। আজকাল আমাদের দেশে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন নিয়ে বই লেখা হচ্ছে। কিন্তু উল্লেখ করা হচ্ছে না যে, সন্ত্রাসবাদীরা ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করে চেয়েছিলেন হিন্দুরাজ্যের প্রতিষ্ঠা। চাকমারা পরিচালিত হচ্ছেন আসলে হিন্দু জাতীয়তাবাদ দ্বারা। তাদেরও লক্ষ্য হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে স্বাধীন করে হিন্দুরাজ্য স্থাপন। চাকমাদের মদদ জোগাচ্ছে ভারত। ভারত কাজে লাগাতে চাচ্ছে চাকমাদের হিন্দুত্ববাদী মনোভাবকে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বলে একসময় কোনো জেলা (মহাল) ছিল না। ১৭৬০ সালে বাংলার নবাব মীর কাসেম চট্টগ্রামের অধিকার ছেড়ে দিতে বাধ্য হন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা গঠন করা হয় এর এক শ’ বছর পরে ১৮৬০ সালে। যতগুলো কারণে এই জেলা গঠন করা হয়, তার মধ্যে একটি কারণ ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের মধ্যে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের সুযোগ করে দেয়া। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের মধ্যে খ্রিষ্টধর্ম সেভাবে প্রচারিত হতে পারেনি। দু’টি প্রধান উপজাতি চাকমা ও মারমারা গ্রহণ করতে চাননি খ্রিষ্টান ধর্ম। খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছেন পাংখা, বনযোগী ও বমের মতো ক্ষুদ্র উপজাতি। তারা গ্রহণ করেছেন ব্যাপটিস্ট খ্রিষ্টধর্ম।
ভারতের মিজোরাম প্রদেশ ব্রিটিশ আমলে ছিল সাবেক আসাম প্রদেশের একটি জেলা। জেলাটির নাম ছিল লুসাই। লুসাই জেলার অধিবাসী লুসাইরা সবাই গ্রহণ করেন ব্যাপটিস্ট খ্রিষ্টধর্ম। লুসাইরা নিজেদের নাম-পরিচয় দিতে শুরু করেন মিজো হিসেবে। ১৯৬০-এর দশকে মিজোরা শুরু করেন তাদের স্বাধীনতা আন্দোলন। ভারত সরকার লুসাই জেলাকে পরিণত করে মিজোরাম প্রদেশে। এর লক্ষ্য ছিল মিজোদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে শান্ত করা। কিন্তু মিজোদের স্বাধীনতা আন্দোলন চলতেই থাকে। মিজোরাম লিবারেশন আর্মি সদস্যরা মিজোরাম থেকে এসে আশ্রয় নিতে থাকে রাঙ্গামাটির গহিন বনে। পাকিস্তান সরকার মিজোদের প্রদান করে সামরিক প্রশিক্ষণ। মিজোরা রাঙ্গামাটি থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে যুদ্ধ করার জন্য গিয়ে থাকেন মিজোরামে। ১৯৭১ সালে প্রায় দুই হাজার মিজো সৈন্য ছিল রাঙ্গামাটিতে। তারা পাকিস্তান সৈন্যের অংশ বলে নিজেদের পরিচয় দিয়ে ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ১৯৭২ সালে সিমলা চুক্তির পর পাক বাহিনীর অন্য সেনাদের সাথে মুক্তি পেয়ে চলে যান করাচিতে।
ভারত এখন চাকমাদের মদদ দিচ্ছে। তারা প্রধানত দু’টি কারণে মদদ দিচ্ছে। যার একটি কারণ হলো চাকমা নেতৃত্বে যদি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, তবে তার সাহায্যে ভারত পারবে বাংলাদেশের ওপর বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করতে। চাকমা রাষ্ট্র কার্যত হতে থাকবে ভারত সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ভারতের প্রভাব বলয়ের বাইরে তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হবে না। অন্য আর একটি কারণ হলো, চাকমা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পেলে ভারতের পক্ষে সম্ভব হবে মিজো প্রদেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। মিজোরা আর কখনোই করতে পারবে না স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, কিছুসংখ্যক লুসাই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলেও বাস করেন। এসব লুসাইর পূর্বপুরুষ ব্রিটিশ শাসনামলে গ্রহণ করেন ব্যাপটিস্ট খ্রিষ্টান ধর্ম। কিন্তু এরা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সংখ্যায় হলেন খুবই সামান্য।
পত্রিকার খবরে দেখলাম আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলছেন (নয়া দিগন্ত; ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১২), পাহাড়িরাই হবেন পার্বত্য চট্টগ্রামের জমির মালিক। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব হবে? কারণ পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল একটি খুবই জনবিরল অঞ্চল। পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশ আমলে বহু বাংলাভাষী মুসলমান গিয়ে বাড়িঘর গড়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামে। করেছেন ফসলের আবাদ। তাদের কি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ছেড়ে চলে আসতে হবে? পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিতে কি থাকবে না তাদের কোনো অধিকার? এক দেশে দুই রকম আইন কিভাবে হতে পারবে? একজন চাকমা জমি কিনে ঢাকায় বাড়ি করতে পারবেন, কিন্তু একজন ঢাকাবাসী রাঙ্গামাটিতে কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামের আর কোনো জায়গায় গিয়ে জমি কিনে বাড়ি করতে পারবেন না! এ ধরনের আইন কি বাংলাদেশের সংবিধানের পরিপন্থী হবে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার যা করতে চাচ্ছে, তার ফলে সৃষ্টি হতে পারে ভয়ঙ্কর এক সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতির। প্রথম কথা, বাংলাভাষী মুসলমান কখনোই ছাড়তে চাইবেন না পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির ওপর তাদের অধিকার পরিত্যাগ করতে। দ্বিতীয়ত, পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম উপজাতি মারমারা কখনোই চাইবেন না পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের কর্তৃত্ব মেনে নিতে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি হয়ে উঠবে ভয়াবহ সঙ্ঘাতময়। ব্রিটিশ আমল থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে মারমা ও চাকমাদের মধ্যে শুরু হতে পেরেছে মনোমালিন্য। ১৯৪৭ সালে চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্তর্ভুক্তি চেয়েছিলেন ভারতের। রাঙ্গামাটিতে চাকমারা উড়িয়েছিলেন কংগ্রেসের পতাকা। অন্য দিকে মারমারা বান্দরবানে উড়িয়েছিলেন বর্মার দোবামা পার্টির পতাকা। মারমারা চেয়েছিলেন বান্দরবান এলাকাকে বর্মার (মিয়ানমারের) সাথে যুক্ত করতে। চাকমা নেতারা দাবি তুলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী রাখা চলবে না। তাদের এই দাবি মানলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। কার্যত হয়ে যাবে স্বাধীন। পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বাধীন হলে বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়বে অনিশ্চিত। লুসাই পাহাড় থেকে উদ্ভূত হয়ে কর্ণফুলী নদী পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এসেছে চট্টগ্রামে এবং পড়েছে সমুদ্রে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারতের চাপে পড়ে করছেন চাকমাদের তোয়াজ। আর এর ফলে বাংলাদেশের স্বার্থ হতে যাচ্ছে বিশেষভাবে বিপন্ন। ১৯৭৩ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান রাঙ্গামাটির এক জনসভায় বলেছিলেন, বাংলাদেশের সব অধিবাসী বাঙালি হিসেবেই বিবেচিত হবে। মনে হচ্ছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সরে আসতে চাচ্ছে এই নীতি থেকে।
বাংলাদেশের উপজাতি সমস্যা নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করলাম কয়েক সপ্তাহ ধরে। কারণ আওয়ামী লীগের উপজাতি নীতি দেশকে ঠেলে দিতে পারে মারাত্মক সঙ্কটেরই মধ্যে। বাংলাদেশ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল জোর করে দখল করেনি। ১৯৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম তদানীন্তন পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয় র্যাডক্লিফ রোয়েদাদের মাধ্যমে। কিন্তু এখন ইতিহাস এমন করে লেখা হচ্ছে, যেন পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল বাংলাদেশ গায়ের জোরে জয় করে সেখানে আধিপত্য করছে। সারা বিশ্বে চলেছে ভারতের পক্ষ থেকে সুকৌশলে নানা প্রচারণা। কিন্তু বিশেষ দুঃখজনক হলেও বাংলাদেশের এমন অনেক বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক আছেন যাদের বক্তব্য হয়ে উঠেছে ভারতের বক্তব্যের সম্পূরক। তাই সংবাদপত্রের পাতায় আমাদের মতো দু-একজনকে লিখতে হচ্ছে বাস্তব পরিস্থিতি বোঝানোর জন্য দীর্ঘ প্রবন্ধ।
এর আগে আমি সাঁওতালদের নিয়ে লিখেছি একটি বড় প্রবন্ধ। অনেকে সাঁওতালদের নিয়ে অনেক কিছু লিখছে। যাদের লেখা পড়ে মনে হতে পারে সাঁওতালেরা বাংলাদেশের মুসলমানের হাতে হচ্ছেন নিগৃহীত। কিন্তু বাস্তবে কি সেটা সত্য? সাঁওতালেরা মুসলমানদের বলেন, ‘তুড়–খ’। অর্থাৎ তুর্কি। কিন্তু তুর্কিরা তাদের ঘরছাড়া করেননি। তারা ঘরছাড়া হয়েছেন ব্রিটিশ শাসনামলে। ব্রিটিশ শাসনামলেই ঘটেছে বিখ্যাত সাঁওতাল বিদ্রোহ। আমার মতে, উপজাতিদের কথা ভাবতে হবে জাতীয় স্বার্থের সাথে সঙ্গতি রেখে। জাতীয় স্বার্থকে খাটো করে উপজাতীয় স্বার্থকে কোনোভাবেই প্রাধান্য দেয়া যেতে পারে না। কারণ উপজাতি জাতি নয়; জাতির একটা ক্ষুদ্র জনসমষ্টি মাত্র। যারা একটি জাতির অংশ হয়ে পড়েছে ইতিহাসের ধারায়।