আমাদের দেশে ভোটের রাজনীতি এসেছিল বিলাত থেকে। ‘সভা’ আর ‘সমিতি’র ধারণা প্রাচীন যুগে আমাদের দেশেও ছিল। ছিল গ্রাম পঞ্চায়েতের ধারণা। কিন্তু ছিল না ঠিক ভোটের রাজনীতি। এর প্রচলন হয় ব্রিটিশ শাসন আমলে। আর সূচনা হয় স্থানীয় সরকারকে নির্ভর করে। এক সময় অনেক খ্যাতনামা নেতা অংশ নিয়েছেন স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তা নির্বাচনে। যেমন ১৯২৫ সালে কলকাতা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন চিত্ররঞ্জন দাস। ডেপুটি মেয়র নির্বাচিত হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর প্রধান কর্মাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন সুভাসচন্দ্র বসু। যাদের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে আমাদের রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাসে। কিন্তু স্থানীয় সরকার আর জাতীয় সরকারের চরিত্র এক নয়। কেননা স্থানীয় সমস্যা আর সমগ্র জাতির সমস্যার মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান।
ব্রিটিশ শাসন আমলে উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ সরকারের কর্মচারীরা পরিচালনা করতেন দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসন। তখন আমাদের দেশে প্রশাসন থাকলেও ঠিক রাষ্ট্র ছিল না। আমরা নিয়ন্ত্রিত হতাম শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ পার্লামেন্ট দ্বারা। আমাদের নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতি বলে কোনো কিছু ছিল না। কিন্তু এখন আমাদের আছে রাষ্ট্র। রাজনীতি বলতে কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার মোকাবেলা বোঝায় না। রাজনীতির একটা বিরাট অংশজুড়ে থাকে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের প্রশ্ন। একটি দলের যোগ্যতার প্রশ্নে কেবল ঘরোয়া সমস্যা সমাধানে তার গৃহীত নীতি আলোচ্য হয় না। বিবেচ্য হয় তার গৃহীত পররাষ্ট্রনীতি।
জাতীয় নির্বাচনে একটা দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের পররাষ্ট্রনীতি কেমন হতে পারে সেটা বিবেচনা করেও ভোটাররা ভোট দেন একটি দলকে। কেবলই তার ঘরোয়া সমস্যা সমাধানে গৃহীত প্রস্তাবনাবলিকে বিবেচনা করে নয়। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের কিছু মৌলিক বিশ্বাস থাকে। তার ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠতে চায় দলটির রাজনৈতিক কর্মসূচি। আওয়ামী লীগের একটি মৌলিক বিশ্বাস হলো বাংলা জাতীয়তাবাদ। অন্য দিকে বিএনপি জনপ্রিয়তা পেতে পেরেছিল বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কথা তুলে ধরে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সে যেন তার এই মৌলিক বিশ্বাস থেকে কিছুটা সরে যেতে চাচ্ছে। আর এ রকম সরে গেলে তার আদর্শিক আবেদন যে কমে যাবে, সেটা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনো দিনই এক দল ক্ষমতায় চিরদিন থাকে না। কেননা দলের দক্ষতা এক থাকে না। উপযুক্ত নেতার অভাব ঘটে। নেতা ও নীতির ওপর দলের আকর্ষণ নির্ভর করে থাকে। জিয়ার যে কর্মদক্ষতা ছিল, সেই তুল্য কর্মদক্ষতা বর্তমান বিএনপিতে কারো মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। দল হিসেবে বিএনপির জনপ্রিয়তা কমার এটা একটা কারণ। ক্ষমতা মানুষকে জেদি, পীড়ক ও স্বার্থপর করে তুলতে চায়। ক্ষমতায় থাকলে একটি দলের নেতারা হয়ে উঠতে চান জেদি, পীড়ক ও স্বার্থপর। জনমত তাই হয়ে ওঠে দলটির প্রতিকূল। নতুন নির্বাচনে জনসমর্থনের অভাবে দলটি হারায় ক্ষমতা। এর স্থলে আসে নতুন দল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এটা বৈশিষ্ট্য।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগে কোনো ব্যক্তি ভোট পেলে যতবার ইচ্ছা প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন। এ ক্ষেত্রে কোনো আইনি বাধা ছিল না। কিন্তু ১৯৫১ সালে মার্কিন কংগ্রেস পাস করে সংবিধানের ২২তম সংশোধনী। এখন আর কেউ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দু’বারের বেশি অথবা আট বছরের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না। এই সংশোধনী আনার কারণ হলো কোনো ব্যক্তি যাতে মহাক্ষমতাধর হয়ে উঠতে না পারেন। কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট দু’বারের বেশি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি, একমাত্র প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন দ্য রুজভেল্ট ছাড়া। তিনি চতুর্থ বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময় মারা যান। তার মৃত্যুর পর ওঠে মার্কিন সংবিধানের ২২তম সংশোধনী আনার প্রশ্ন। মার্কিন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা বিদায়ের আগে বলেছেন, এই আইন না হলে তিনি আবার নির্বাচনে দাঁড়াতেন এবং হতে পারতেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
আমাদের দেশ প্রেসিডেন্ট শাসিত নয়। কিন্তু হয়ে উঠতে চাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শাসিত দেশ। তাই মনে হয়, আমাদের দেশে আইন হওয়া উচিত দু’বারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। এটা একটা সমস্যা, কেউ ক্ষমতা না থাকলে কিছু করতে পারেন না। আবার এটাও সমস্যা, কেউ বেশি ক্ষমতা পেলে হয়ে উঠতে চান স্বৈরাচারী। রাজনীতির অন্যতম সমস্যা হলো ক্ষমতার ভারসাম্য স্থাপন। একটি দেশে গণতন্ত্র সাফল্য পেতে হলে দলগুলোকে গণতন্ত্রী হতে হয়। আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হোঁচট খাচ্ছে। তার একটা কারণ দলগুলো গণতন্ত্রী হতে পারছে না। দলে গণতন্ত্র না থাকার প্রভাব পড়ছে দেশের সাধারণ রাজনীতিতে। আমরা বিলাতের কাছ থেকে গণতন্ত্রের সবক পেয়েছি। কিছু দিন আগে দেখলাম বিলাতে গণভোট করা হলো, গ্রেট ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কি থাকবে না সেটা ঠিক করা নিয়ে। ব্রিটেনে ক্ষমতায় আছে রক্ষণশীল দল। রক্ষণশীল দলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরন। ক্যামেরন চেয়েছিলেন ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকুক। কিন্তু গণভোটের ফল গেল তার ইচ্ছার প্রতিকূলে। ক্যামেরন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিলেন। তার দলের থেকেই আরেকজন হলেন প্রধানমন্ত্রী, যিনি ছিলেন গ্রেট ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন পরিত্যাগের পক্ষে। এটা হলো দলে গণতন্ত্র থাকার একটা উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। যেটার কথা এখনো আমাদের দেশে ভাবতে পারা যায় না।
৩০ ডিসেম্বর ২০১৬,শুক্রবারে প্রকাশিত।