জন্মেছিলাম বৃটিশ ভারতের নাগরিক হিসেবে। বৃটেন যখন এই উপমহাদেশ ছেড়ে যায় তখন আমার বয়স চলেছে ১৭ বছর। এরপরে হলাম পাকিস্তানের নাগরিক। তারপরে এখন হলাম বাংলাদেশের। যদিও ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে আছি সেই একই স্থানে। আমি রাজশাহী শহরে জন্মেছিলাম ২৯ ডিসেম্বর ১৯২৯ সালে। আর এখনও আছি সেই একই জায়গায়। অবশ্য ভিন্ন মহল্লায়। আমার কর্মজীবনও কাটলো প্রধানত এই একই শহরে। আমার মনমানসিকতা রচিত হয়েছে এই শহরের পরিবেশে। এই শহর থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। আমি পদ্মাপাড়ের বাসিন্দা। এই নদীও রেখেছে আমার জীবনে বিরাট প্রভাব। যদিও আমার পূর্বপুরুষ ছিলেন মধ্যবঙ্গের লোক। কিন্তু আমি উত্তরাধিকার সূত্রে মধ্যবঙ্গের কিছু সংস্কৃতি লাভ করে থাকলেও আমার সংস্কৃতি হলো বরেন্দ্রভূমির। বলা যায় বেশকিছু ব্যাপারে রাজবংশী প্রভাবিত।
দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান রাষ্ট্রটির উদ্ভব হতে পেরেছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। এই জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হতে পেরেছিল বৃটিশ শাসনামলে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতিক্রিয়ায়। হিন্দুরা মুসলমানকে ঘৃণা করেছে অস্পৃশ্য বা ম্লেচ্ছ হিসেবে। এই ঘৃণা সৃষ্টি করেছে মুসলিম জাতীয়তাবাদ। মুসলিম নৃপতিদের শাসনামলেও এই স্লেচ্ছতাবাদ ছিল। খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে মরোক্কো থেকে বিখ্যাত আরব পর্যটক ইবনে বতুতা এসেছিলে তখনকার বাংলায়। তিনি তাঁর ভ্রমণ কাহিনিতে লিখেছেন, তৃষ্ণার্ত মুসলমান পথিক পানি চাইলে হিন্দুরা তা প্রদান করে না। কারণ, তারা ভাবে এর ফলে তার পানপাত্র অপবিত্র হবে।
বৃটিশ শাসনামলে মুসলমানকে সাধারণভাবেই অপবিত্র বা ম্লেচ্ছ ভাবা প্রকট রূপ লাভ করতে পারে। সৃষ্টি হতে পারে দ্বিজাতিতত্ত্ব। দ্বিজাতিতত্ত্বটা প্রথমে মুসলিম জনসমষ্টির মধ্যে থেকে উত্থিত হয়নি। সাবেক পাঞ্জাব প্রদেশের বিখ্যাত হিন্দু নেতা লালা লাজপৎ রাই ১৯২৫ সালে এই উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিম বিরোধের অবসানের জন্য উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে দুইটি মুসলমান প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন; কোনো মুসলমান নেতা নন। আমাদের দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী মনে করেন, রাজনীতিতে ধর্ম-সামাজিক বিরোধ টেনে আনা উচিত নয়। কিন্তু ধর্ম-সামাজিক বিরোধ পৃথিবীর নানা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছে।
বর্তমানে আমরা দেখছি রোহিঙ্গা- সমস্যা সৃষ্টি হতে। দেখছি মিয়ানমারে থেরাবাদী বৌদ্ধধর্মকে কেন্দ্র করে উগ্র বর্মী ধোবাদী বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি হতে। যা আমাদের আগামী ইতিহাসকে প্রভাবিত করবে বলেই মনে হচ্ছে। প্রতিটি দেশে পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারিত হয় তার জাতীয় ইতিহাসের ধারায়। এবং তার ভৌগোলিক অবস্থানকে নির্ভর করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটবে বলে মনে করবার কারণ নাই। জাতীয়তাবাদ বর্তমান বিশ্বে নতুন করে একটা প্রবল রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠছে। এই জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি হতে পারছে ধর্ম-সামাজিক কারণে, সৃষ্টি হতে পারছে ভাষা ও মানবধারা ভিন্নতাজনিত কারণে। যে কারণেই হোক, পৃথিবী নানা জাতি এবং জাতি-রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে আছে। আর জাতিতে জাতিতে হতে দেখা যাচ্ছে যুদ্ধ। আমরা যদি মনে করি সব আন্তর্জাতিক বিরোধ শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান সম্ভব হবে, তবে বড় রকমের ভুল সিদ্ধান্ত হবে। আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে যুদ্ধেরও জন্য। আমার জন্মদিনের আলোচনার প্রথম উপসংহার এটাই। যদিও উপসংহারটি অনেকের কাছে মনে হতে পারে যথেষ্ট অপ্রিয়
মানুষ ধনবান হলেই হবে খারাপ আর গরিব হলেই হবে ভালো, আমি এই ধারণায় আস্থাবান নই। আমি মনে করি ধনবান ব্যক্তিদের মধ্যেও থাকতে পারেন মানব কল্যাণে উৎসাহী ব্যক্তিবর্গ। মানুষের ইতিহাস কেবলই তার ব্যক্তিগত স্বার্থবুদ্ধির ইতিহাস নয়: মানুষের ইতিহাস তার সমবেত শ্রেয় বুদ্ধিরও ইতিহাস। মানুষের মধ্যে যেমন আছে হেয় বৃত্তি; যেমন কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য, তেমনি আবার কাজ করে চলেছে পরার্থপরতা, আছে মুদিতা বা অপরের সুখে সুখী হবারও ইচ্ছা। মানুষ কেবল একা বাস করতে চায় না, কামনা করে অপরের সান্নিধ্য। যেসব ব্যক্তি দক্ষিণ মেরু আবিষ্কারের জন্য অভিযান চালিয়েছিলেন, তাদের অনেকের ডায়রিতে দেখা যায় যে, তারা রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছেন সবুজ মাঠের; আর অগণিত মানুষের। দক্ষিণ মেরুর তুষার-ধবল পরিবেশে তাদের স্বপ্নের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল সবুজ মাঠ আর জনসমষ্টি । মানুষের সান্নিধ্য খুঁজছিল তাদের অবচেতন মন।
ধর্মকে সমালোচনা করা আমাদের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের একটা অভ্যাস হয়ে পড়েছে। কিন্তু ধর্মের সবকিছুকেই খারাপ বলে অবজ্ঞা করতে চাওয়া ভুল। জন স্টুয়ার্ট মিলের মতো আমারও মনে হয়, ধর্মের অন্যতম লক্ষ্য হলো, অনুভবের চর্চা। মানুষের জন্য মানুষের সমবেদনা ধর্মের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। ধর্ম কেবলই একটা পারলৌকিক বিশ্বাসের বিষয় নয়। এর একটা বিরাট অংশই হলো ইহজাগতিক। আল-কুরআনে তাই বিশেষভাবে বলা হয়েছে, দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে আহার্য প্রদান করতে (সুরা ৯০:১৪)। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা বিজ্ঞানের জয়গান করতে ব্যস্ত। কিন্তু আজকের বিশ্ব একটি বিরাট সংকটের মধ্যে পড়েছে, বিজ্ঞানেরই কারণে। কেননা, বৈজ্ঞানিকেরা আবিষ্কার করেছেন ভয়াবহ মারণ আয়ুধ। বিজ্ঞান মূল্যচেতনার চিন্তা করে না। কিন্তু ধর্ম করে। তাই মানব সমাজে ধর্মের প্রয়োজন শেষ হয়ে গিয়েছে। আমরা এখন বাস করছি কেবলই বিজ্ঞানের যুগে। এই বিশ্বাসকে আমি প্রশ্রয় দেবার পক্ষে নই। আমার জন্মদিনের আলোচনার তৃতীয় উপসংহার হচ্ছে মানুষের জীবনে ধর্মের প্রয়োজন নিঃশেষ হয়ে যায়নি। বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস সংঘাতের জন্ম দেয়। এটা যেমন সত্য, তেমনি আবার সত্য যে, ধর্ম বিশ্বাস মানুষের মনে সৃষ্টি করে একটা উৎসর্গের মনোভাব। যেটাকে অস্বীকার করলে মানব ইতিহাসের একটা বড় চালিকাকেই অস্বীকার করা হয়।
কদিন আগে বাংলাদেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর মন্তব্য করেছেন, ধনতন্ত্র নাকি আর বেশিদিন টিকবে না। বিশেষ করে মার্কিন ধনতন্ত্র (যুগান্তর, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭)। তিনি কেন এরকম মন্তব্য করেছেন, আমি তা জানি না। আমার মনে হয় তিনি ধারণা করেন যে, মার্কিন ধনতন্ত্র না থাকলে পৃথিবীতে আসবে একটি স্বর্ণযুগ। প্রতিষ্ঠা পাবে মানব সমতা। কিন্তু আমরা কি এত এত সম্পদ উৎপাদন করতে সক্ষম যে, বিশ্বকে দারিদ্র্যমুক্ত করা সম্ভব হবে। বিশ্বে দারিদ্র্য আছে কেবলই ধনবান ব্যক্তিরা আছে বলেই নয়। সকলকে দেবার মতো ধন উৎপাদিত হচ্ছে না বলেই বহু মানুষকে থাকতে হচ্ছে দরিদ্র্যসীমার নিচে। অর্থনীতির হলো দুটি দিক। একটি দিক হলো ধন (Wealth), আর একটি দিক হলো উৎপাদিত ধন মানুষের মধ্যে বণ্টনের (Distribution)। আমরা যদি মনে করি মানুষ অনাহারে আছে, ব্যবসায়ীরা খাদ্যশস্য মজুদ করে বেশি দামে বিক্রি করে লাভবান হতে চাচ্ছে বলেই। তবে সেটা হবে একটা অর্ধসত্য, পূর্ণসত্য নয়। খাদ্যশস্য যথেষ্ট উৎপাদিত না হলে দুর্ভিক্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। কার্ল মার্কস তার ক্যাপিটাল গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে বলেছেন, ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারিরা খাদ্যশস্য কিনে মজুদ করেছিল পরে বিক্রি করে বিপুলভাবে লাভবান হতে পারবে বলে। এর ফলে হতে পেরেছিল ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ (বাংলায় একে আমরা বলি ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, কারণ এই দুর্ভিক্ষ ঘটেছিল ১১৭৬ বঙ্গাব্দে)। কিন্তু এই দুর্ভিক্ষের একমাত্র কারণ মজুদদারি ছিল না। ১৭৬৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত একটানা হয়েছিল হুরা। ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছিল খুবই কম। তাই দুর্ভিক্ষ নিতে পেরেছিল ভয়ংকর রূপ। এ সময়ের একজন গ্রাম্য কবি লিখেছেন:
নদনদী খালবিল সব শুকাইল।
অন্নাভাবে লোকসব যমালয়ে গেল৷
দেশের সমস্ত চাল কিনিয়া বাজারে।
দেশ ছারখার হলো রেজা খাঁর তরে।
এই সময় রেজা খাঁ ছিলেন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির নায়েব-সুবা। তিনি করেছিলেন বিশেষভাবে খাদ্যশস্য মজুদ। পরে তা বেশি দামে বিক্রি করে লাভবান হবার উদ্দেশ্যে। কিন্তু খাদ্যশস্যের ফলন প্রাকৃতিক কারণে অত কম না হতো, তবে দুর্ভিক্ষ কখনই ওই রকম ভয়ংকর রূপ লাভ করতে পারত না। এইটাই হলো এখনকার ঐতিহাসিকদের ধারণা। বৃটিশ শাসনামলে চেষ্টা শুরু হয় খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়িয়ে দুর্ভিক্ষের প্রকোপ কমানো। এই প্রচেষ্টার বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন লর্ড কার্জন। লর্ড কার্জন (১৮৯৯-১৯০৫) সমবায় ঋণ সমিতি গঠনের আইন প্রবর্তন করেন। তিনি প্রথম উচ্চবিদ্যালয় স্থাপন করেন কৃষিবিদ্যা শিক্ষাদানের জন্য। তার সময় স্থাপিত হয় এদেশে কৃষি গবেষণাগার। লর্ড কার্জনের সময় ১৯০৫ সালে বিহারের দারভাঙ্গা জেলার পুসা (Pisa) নামক জায়গায় স্থাপিত হয়েছিল একটি বিখ্যাত কৃষি বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র।
এই গবেষণাগার স্থাপনের জন্য অর্থ প্রদান করেছিলেন হেনরী ফিস (Henry Phipps) নামক একজন ধনবান মার্কিন নাগরিক। তিনি এই উপমহাদেশে বেড়াতে এসে দুর্ভিক্ষপীড়িত লোকের কষ্ট দেখে লর্ড কার্জনকে প্রদান করেছিলেন ৩০ হাজার পাউন্ড, একটি কৃষি গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করতে। ১৯৩৪ সালের ভূমিকম্পে এই কৃষি গবেষণাগারটির খুব ক্ষতি হয়। ১৯৩৬ সালে পুসা থেকে এই গবেষণাগারটি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় নতুন দিল্লিতে। আমি ঘটনাটির কথা উল্লেখ করছি এই জন্য যে, হেনরি ফিস ছিলেন একজন মার্কিন নাগরিক। তিনি তার আর্থিক অনুদান প্রদান করেছিলেন এই উপমহাদেশে দুর্ভিক্ষের প্রকোপ কমাবার জন্য। বদরুদ্দীন উমর সাহেবদের থিওরি দিয়ে এরকম মানবিক কর্মের ব্যাখ্যা করা যায় না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখনও মানবদরদী ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অভাব নাই। আমি তাই মনে করি না, মার্কিন ধনতন্ত্র বদরুদ্দীন উমর সাহেবরা যত সহজে ভেঙে পড়বে বলে মনে করছেন, তা হতে যাচ্ছে। মার্কিন ধনতন্ত্র কোনোদিনই একেবারে সেদেশের সরকারের নিয়ন্ত্রণহীন ছিল না। মার্কিন কৃষি অর্থনীতিতে থেকেছে সরকারি সাহায্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সেদেশের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার গবেষণার জন্য ব্যয় করেছে এবং করছে প্রচুর অর্থ। তবে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির সময় বিবেচনায় রাখতে হয় কৃষিপণ্যের বাজার দর সম্বন্ধেও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষিপণ্যের বাজারদর যাতে অতি উৎপাদনের ফলে পড়ে যেয়ে কৃষকের ক্ষতি না হয় সে জন্য উপনীত হয়েছে নানাবিধ আইন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি কেবলই কলকারখানা অর্থনীতি নয়। আর তা পরিচালিত হচ্ছে না কেবল ব্যক্তিস্বার্থ প্রণোদিত ব্যক্তির দ্বারাও নয়। তাদের মধ্যে থাকতে দেখা যায় মানবদরদী ব্যক্তিদেরও।
গ্রেট বৃটেনে ঘটেছিল প্রথম শিল্প-বিপ্লব। যার আরম্ভকাল ধরা হয় ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি থেকে। বৃটেনে এখন তিন মাসের খাদ্য উৎপন্ন হয়। বাদবাকি ৯ মাসের খাদ্য সে আমদানি করে বিদেশ থেকে। এটা সে আমদানি করে তার দেশে উৎপাদিত শিল্পবস্তু বাইরে বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থের দ্বারা। কিন্তু পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কৃষি গবেষণাগার হলো বিলাতের রথহ্যামস্টেড (Rothamsted)। রথহ্যামস্টেড একটি জায়গার নাম। এখানে কৃষি গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন জে বি লাওয়েস (J.B. Lawes)। লাওয়েস ছিলেন কেমিস্ট্রির ছাত্র। তিনি রথহ্যাস্টেডের জমিদারি পেয়েছিলেন পৈতৃক উত্তরাধিকার সূত্রে। তিনি নিজ উদ্যোগে ও অর্থে স্থাপন করেছিলেন এই কৃষি গবেষণাগার। এখানে আবিষ্কৃত হয়েছিল সুপার ফসফেট ও এ্যামোনিয়াম সালফেটের মতো রাসায়নিক সার। এই গবেষণাগারে কাজ শুরু হয়েছিল ১৮৩৮ সাল। থেকে। লাওয়েস তার সমস্ত বিত্ত ও এই গবেষণাকেন্দ্রটি দান করে যান তার সরকারকে। এটাকেও বলা যায় একটা নিঃস্বার্থ মনমানসিকতার পরিচায়ক হিসেবে। সারাবিশ্বই কৃষিতে সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে লাওয়েস ও তার বন্ধু গিলবার্ট যে গবেষণা করে গিয়েছেন, তার কাছে ঋণী। এদের মতো ব্যক্তির চেষ্টাতেই কমে আসতে পারছে মানুষের ক্ষুধার সমস্যা; খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি হবার ফলে।
বাংলাদেশে অনেক রাজনৈতিক নেতা এ যাবদ জন্মেছেন। আমার বিশেষ শ্রদ্ধা হয় আবুল কাসেম ফজলুল হক সাহেবের ওপর। কেননা তিনি ভেবেছিলেন এ দেশের কৃষিজীবী মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের কথা। তিনি গড়েছিলেন ঋণ-সালিশি বোর্ড। যা লাঘব করেছিল কৃষকের ঋণের বুঝা। ১৯৪০ সালে তিনি পাস করেছিলেন মহাজনি আইন। এর মাধ্যমে চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ গ্রহণ বন্ধ হয়। এর আগে ১৯৩৮ সালে তিনি পাস করেছিলেন প্রজাস্বত্ব আইন। কৃষি শিক্ষার জন্য তিনি ১৯৩৮ সালে ১১ ডিসেম্বর ঢাকার কাছে তেজগাঁতে স্থাপন করেন বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ইন্সটিউটের (বি.এ.আই) ভিত্তিপ্রস্তর। যা পাকিস্তান হবার পর নাম পায়, ইস্ট পাকিস্তান এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট। আমি এই প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করে ১৯৫৩ সালে লাভ করেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিয়ে কৃষি গ্র্যাজুয়েট (B.Ag) ডিগ্রি।
এরপরে আমি পড়েছিলাম বিলাতের লিড্স বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিষয়ে। তারপর পড়াশোনা করেছিলাম ফ্রান্সে কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জীবাণুতত্ত্ব সম্বন্ধে পারি শহরের সবচেয়ে বড় কৃষি বিদ্যালয়ে এবং ডক্টরেট ডিগ্রি লাভের জন্য করেছিলাম গবেষণা। ফ্রান্সের পুয়াতিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেছিলাম ডক্টরেট খেতাব। দেশে ফিরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটানা ৩০ বছর অধ্যাপনা করেছিলাম উদ্ভদবিদ্যা বিভাগে পড়িয়েছিলাম প্রধানত উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব। আমি আমার জন্মদিনে আমার ব্যক্তিগত জীবনের এসব কথা বলছি, কারণ আমি সবসময় ভেবেছি দেশের মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন করবার কথা। আর ভেবেছি এটা করতে হলে বাড়াতে হবে কৃষি উৎপাদন ।
আমাদের দেশে এখন আর আগের মতো ঘনঘন এবং ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ হচ্ছে না। কৃষিতে ঘটেছে উন্নয়ন। তা না হলে দুর্ভিক্ষ হতো। ১৯৭৪ সালে হয়েছিল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। তারপরে আর হয়নি। মানুষ এখন আগের তুলনায় ভালো খেতে পারছে। হতে পারছে মানুষের কর্মসংস্থান। আমি তাই হতে চাই না দেশ সম্পর্কে হতাশাবাদী। আমি তাই আমার জন্মদিনে ব্যাপ্ত করতে চাই বিশেষ আশাবাদ। আমার মতামত অনেকের সাথেই মিলতে চাই না। কারণ আমি শিক্ষিত হয়েছি একজন কারিগরি বিদ্যার মানুষ হিসেবে; মানবিকী বিদ্যার ছাত্র হিসেবে নয়।
নয়া দিগন্তে যারা স্তম্ভ রচনা করছেন তাদের শিক্ষাগত পটভূমি প্রধানত হলো মানবিকী। আর আমার তা নয়। আমি অবশ্য বিষয়েই বই লিখেছি। যেসব বিষয় আমি অনুশীলন করেছি নিজে ব্যক্তিগতভাবে। আমি এসব বিষয়ে বই লিখেছি অনানুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে। আমার জীবন কেটেছে একজন পেশাদার শিক্ষক হিসেবে। আর শিক্ষকরা চান শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে দেশের মানুষের সম্বিৎ বাড়াতে। অনেকদিন ধরেই নয়া দিগন্ত পত্রিকায় স্তম্ভ রচনা করছি। এই পত্রিকার সাথে আমার যোগাযোগ কীভাবে ঘটেছিল তা আর এখন মনে নেই। তবে আমি যা লিখি তা আমার ভাবনা-চিন্তার ফল। এই পত্রিকার মতামত তা নয়। এরা যে আমাকে আমার মতো প্রকাশের সুযোগ দিচ্ছেন, সে জন্য আমি আমার জন্মদিনে এদেরকে জানাই আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।
৬ জানুয়ারি ২০১৮ তে দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশ।