জনাব এবনে গোলাম সামাদকে প্রধানত রাজনৈতিক বিষয়ের কলাম লেখক হিসেবেই জানি। ৩০ জুলাই নয়া দিগন্ত পত্রিকায় ‘আমাদের চিত্রকলা’ বিষয়ে কলাম লিখেছেন তিনি। ইতঃপূর্বে চিত্রকলাবিষয়ক তার কোনো লেখা পড়েছি বলে মনে পড়ে না। চিত্রকলা বিষয়ের গভীরে প্রবেশ, সত্যান্বেষণ এবং সত্য প্রকাশে স্বতঃস্ফূর্ততা এ লেখার বিষয়ে বিস্ময়ের কারণ। আমাদের দেশে যারা শিল্পকলা বিষয়ে নিজেকে পণ্ডিত মনে করেন এবং লিখে থাকেন তাদের লেখায় এসব লক্ষ করা যায় না। এবনে গোলাম সামাদ ক্ষুদ্র পরিসরে আমাদের চিত্রকলা বিষয়ে যে অভিমতগুলো তুলে ধরেছেন, সেগুলো পড়ে আমার মনে হয়েছে, চিত্রকলা তথা শিল্পকলা বিষয়ে তিনি গভীর জ্ঞানের অধিকারী। তার কলাম পড়ে নিজেও বেশ কিছু নতুন তথ্য পেয়েছি এবং অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ হয়েছে। অবশ্য তার সব বক্তব্যের সাথে একমত হতে পারিনি।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ১. ‘জয়নুল আবেদিন বিশেষভাবে খ্যাত হয়ে ওঠেন তার আঁকা ১৯৪২-৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের ছবির জন্য।… যারা দুর্ভিক্ষ দেখেননি অথবা দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে কিছু জানেন না, তাদের কাছে এই ছবিগুলো মনে হবে না আবেদনবহ। কেননা এই ছবিগুলোর ছবি হিসেবে বিশেষ মূল্য নেই। …জয়নুল আবেদিন তার এসব ছবির জন্য বিশেষ প্রশংসা পান কলকাতার কমিউনিস্টদের কাছ থেকে। …অন্য দিকে মুসলিম লীগের সমর্থকেরা তাকে এসব আঁকার জন্য করেন বিশেষভাবে ভর্ৎসনা। কেননা, এ সময় বাংলার বিধানসভায় মন্ত্রিপরিষদ ছিল খাজা নাজিমুদ্দিনের। আর এই মন্ত্রিপরিষদের খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়, জয়নুল আবেদিন এসব ছবি এঁকেছেন মুসলিম লীগ বিরোধী এবং বাম চেতনা থেকে।’
যারা ১৯৪২-৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ দেখেননি কিংবা দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে যারা কিছু জানেন না, তাদের কাছে ছবিগুলো আবেদনবহ না হওয়ার কারণ নেই এবং ছবিগুলোকে মূল্যহীন বলারও যুক্তি খুঁজে পাই না। কারণ ছবিগুলো তাদেরই জন্য যারা দুর্ভিক্ষ দেখেননি। কী ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল সেই দুর্ভিক্ষের সময়, ধনিক শ্রেণীর মানুষেরা সে সময় অসহায় দরিদ্র মানুষের সাথে কতটা অমানবিক আচরণ করে তাদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছিল, জয়নুলের দুর্ভিক্ষের ছবিগুলো এরই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। জয়নুলের ছবিগুলো সে সময়কার বিত্তবান মানুষ এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের কর্তাব্যক্তিদের অমানবিক আচরণ ও অবহেলার ইতিহাস রচনা করেছে। ছবিগুলো দর্শনে নিরক্ষর মানুষও বুঝতে পারে, জীর্ণশীর্ণ হাড্ডিসার মৃত মানুষগুলো কতটা ভয়াবহ যন্ত্রণা সহ্য করেছে। সুতরাং মূল্যবান ছবিগুলোকে মূল্যহীন বলার যুক্তি দেখি না।
জয়নুল আবেদিন অবহেলিত, পীড়িত ও মৃত মানুষের ভয়াবহ দুর্দশার ছবি এঁকেছেন বলে কমিউনিস্টদের প্রশংসা পেয়েছেন। ধনিক ও লুটেরা শ্রেণীর বিত্তশালী মানুষেরা কখনোই দরিদ্র, অবহেলিত ও নির্যাতিত মানুষের পক্ষে দাঁড়ায় না; বরং তাদের শোষণ করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। কমিউনিস্টরা প্রশংসা করেছেন আর শাসকেরা ভর্ৎসনা করেছেন বলেই জয়নুলের দুর্ভিক্ষের চিত্রকর্মগুলো মূল্যহীন কিংবা আবেগহীন হয়েছে, এ কথা কোনোভাবেই বলা যাবে না। বিদেশী সমালোচক এরিক নিউটন, রিচার্ড গ্যারেট উইলসন, জন বাকল্যান্ড রাইটসহ বহু সমালোচক জয়নুল এবং তার দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ডলফ রিজার বলেছেন, ‘The outstanding feature of this exhibition is the remarkable collection of brush drawing of victims of the Bengal faminc of 1943- the horror of starving groups of human beings and of emaciated corpses surrounded by watchful ravens is dramatically caught in flowing brush strokes and by a variation of sensitive lines.’ (New Values, Vol. 4, No. 2 and 3, 1952, P. 17)।
২. শিল্পী এস এম সুলতান সম্পর্কে এবনে গোলাম সামাদ যে মন্তব্য করেছেন তা যথার্থ। তিনি লিখেছেন, ‘সুলতানের ছবিতে ধরা পড়েছে বাংলাদেশের নিসর্গ এবং কৃষিজীবী মানুষের জীবনযাত্রা। …তিনি একমাত্র শিল্পী যাকে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ প্রকৃত প্রস্তাবে কিছু গৌরব করতে পারেন।’ শিল্পী সুলতান বাংলাদেশের গৌরব তাতে সন্দেহ নেই। তবে তিনিই ‘একমাত্র শিল্পী যাকে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ গর্ব করতে পারে’, এ মন্তব্য একপেশে। লেখক সুলতানের ছবিতে বাংলাদেশের প্রকৃতি এবং পেশিবহুল মানুষ দেখেছেন। জয়নুলের ছবিতে বাংলাদেশের প্রকৃতি এবং বাংলাদেশের কৃষক বা খেটে খাওয়া মানুষকে কেন দেখতে পাননি? জয়নুলের ছবির সব অংশজুড়েই রয়েছে প্রকৃতি, মানুষ, সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলার করুণ দৃশ্যাবলি। সুলতান যতটা না বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি তুলে ধরেছেন জয়নুল। যেমন- গ্রামীণ নিসর্গ, সাঁওতাল, নবান্ন, ঝড় ও সংগ্রাম, দুমকা, মই দেয়া, মাছ ধরা, বুড়িগঙ্গা, জেলে নাও, ফসল, ওরা কাজ করে, গুণটানা, মুক্তিযুদ্ধ, মনপুরা প্রভৃতি। এসব দৃষ্টান্ত লেখকের দৃষ্টি এড়িয়ে গেল কিভাবে?
৩. শিল্পী কামরুল হাসানের চিত্রকর্ম সম্পর্কে লেখক হতাশাজনক মন্তব্য করেছেন। কামরুল হাসানের চিত্রকর্মে তিনি পটচিত্রের প্রভাব লক্ষ করেননি। অথচ কোনো কোনো শিল্পবোদ্ধা তার চিত্রে পটচিত্রের ব্যাপক প্রভাব লক্ষ করার কারণে তাকে ‘পটুয়াচার্য’ খেতাবে অভিষিক্ত করেছেন। বাংলার অতি সাধারণ পটচিত্র আঁকা মানুষের মতোই তিনি নিজেকে পটুয়া ভাবতে ভালোবাসতেন। এবনে গোলাম সামাদ কামরুল হাসানের বিশেষ স্টাইলের চিত্রকর্ম সম্পর্কেও সমালোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন… ‘আমি মনে করি না প্রাকৃতিক রূপের বিকৃতি ঘটালেই তা উচ্চমার্গের শিল্পকলা হিসেবে পদবাচ্য হওয়ার যোগ্য।’ লেখক যথার্থ মন্তব্য করেছেন। কারণ প্রকৃতির কিংবা কোনো বিষয়ের বিকৃতি ঘটালেই তা উচ্চমার্গের শিল্প হয় না। এর সাথে আরো অনেক কিছুর সমন্বয় ঘটাতে হয়। যেমন, বিকৃতি ঘটানোর সঙ্গত কারণ বা যুক্তি, তাল-লয়, ভারসাম্য, অনুপাত, বিষয়ের ঐক্য বা সামঞ্জস্যপূর্ণ বিন্যাস, স্মরণযোগ্য রূপারোপ, স্বকীয় বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি। শিল্পীর শিল্পকর্মে যদি এসব বিষয়ের সমন্বয় না ঘটে তা প্রকৃত শিল্পের মর্যাদা পায় না। কামরুল হাসানের চিত্রকর্ম এ আলোকেই বিবেচনা করা প্রয়োজন। তিনি পশ্চিমের শিল্প ধারার কিছু অনুকরণের চেষ্টা করেছেন; কিন্তু তাই বলে তার সব চিত্রকর্মকে ঢালাওভাবে পশ্চিমের অনুকরণ বলা সঙ্গত হবে না। অথচ লেখক বলেছেন, ‘কামরুল হাসানের ছবি আমার কাছে যথেষ্ট উচ্চমানসম্পন্ন বলে প্রতিভাত হয়নি। বরং মনে হয়েছে তিনি করেছেন ধার করা আদর্শের বিশেষ চর্চা।’
এবনে গোলাম সামাদ তার কলামের শেষ দিকে ইসলাম ধর্মের সাথে শিল্পকর্ম চর্চার সঙ্ঘাতের বিষয় উল্লেখ করেছেন। সুন্নিদের অনুসৃত বহু হাদিস শিয়া মুসলমানেরা মানেন না, এ কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। এ জন্যই হাদিসে মানুষ ও জীবজন্তুর ছবি আঁকা হারাম বলা হলেও শিয়ারা তা মানেন না। ফলে শিয়া শিল্পীরা জীবজন্তুর ছবি এবং মানুষের ছবি তো এঁকেছেনই, এমনকি হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর ছবিও এঁকেছেন। যাঁর ছবি আঁকা একেবারেই নিষিদ্ধ।
বাস্তবে সুন্নি মুসলমান শিল্পীরাও ব্যাপকভাবে জীবজন্তু এবং মানুষের ছবি এঁকেছেন। ফলে ‘ইসলামিক শিল্পকলা’ নামে বিশাল জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। কোন হাদিস সঠিক, কোনটি সঠিক নয়; কোন হাদিস সহি আর কোন হাদিস জয়িফ- এ নিয়ে বিভ্রান্তি অনেকের মাঝেই কাজ করে থাকে। অনেকের ধারণা, পবিত্র কুরআনে শিল্পের পক্ষে সমর্থন রয়েছে। এবনে গোলাম সামাদ কুরআনের সূরা ৩৪ : ১৩-এর উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন ‘সোলেমান নবীর বিরাট রাজপ্রাসাদ তাঁর হুকুমে জিনরা বানিয়েছিল। এই রাজপ্রাসাদের খিলান সুন্দর দেখাবার জন্য জিনরা সেখানে বসিয়েছিল মূর্তি।’ তিনি আরো লিখেছেন- ‘এ বিষয়ে মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যাতে বক্তারা অভিমত দেন যে, পূজার মনোভাব নিয়ে মানুষ এবং জীবজন্তুর ছবি আঁকা ও মূর্তি গড়া যাবে না; কিন্তু শিল্পকলার প্রয়োজনে যাবে।’ ইসলাম ধর্মে মানুষ ও জীবজন্তুর ছবি আঁকার পক্ষে-বিপক্ষে অসংখ্য অভিমত পাওয়া যায়। তবে পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যা নিয়ে কোনো বিতর্ক লক্ষ করা যায়নি। মানুষ ও জীবজন্তুর ছবি আঁকাকে অনেকে বৈধ মনে করেন। তবে হাদিসের বিধিনিষেধের কারণে অনেকেই মানুষ ও জীবজন্তুর ছবি আঁকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না।
লিখেছেন ড. আব্দুস সাত্তার, প্রকাশিত হয় দৈনিক নয়া দিগন্তে, ২০১৬ সালে।