ড. এবনে গোলাম সামাদ: স্মৃতিপর্ব

এবনে গোলাম সামাদকে নিয়ে পাচ পর্বে লিখিত এই স্মৃতিকথনটি প্রথমে ফেসবুকে ধারাবাহিকভাবে প্রচার করা হয়। পরবর্তীতে লেখকের অনুমতিতে তা পাঠকের জন্যে একত্রে প্রকাশ করা হল।
১৯৯২ সাল। রাজশাহী কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি। লাইব্রেরিতে যেতাম। দেখতাম নিবিষ্ট মনে বই পড়ছেন একজন প্রবীন অধ্যাপক। পরে লাইব্রেরিয়ানের কাজে জেনেছি, তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এবনে গোলাম সামাদ।
স্যারে সঙ্গে মাঝে মাঝে সোনাদীঘির মোড়ে দেখা হতো। দেখা হতো সিটি প্রেসক্লাবে। ড. এবনে গোলাম সামাদের চিন্তার প্রভাব রয়েছে আমার মনে। স্যারের অনুসন্ধানী মন আমাকে তাড়িত করে। স্যারের কথা মনে পড়লে চোখে জল আসে। একজন গভীর প্রজ্ঞাবান মানুষ কতো সাধারণ হতে পারেন তার উদাহরণ তিনি। প্রায় এক যুগ স্যারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। কতো প্রবলভাবে আমাদের সমৃদ্ধ করেছেন তা বলে বুঝানো যাবে না।
আমার বিবেচনায় স্যার শতাধিক বিষয় পড়ানোর সক্ষমতা রাখতেন। পিউর সাইন্স থেকে কলা, সমাজ বিজ্ঞান আরো কতো কিছু। বাড়িয়ে বলার কিছু নেই; যারা স্যারের সান্নিধ্য পেয়েছেন তারা জানেন তাঁর উচ্চতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির জার্নাল সেকশনে দেখি স্যার গভীর মনোযোগ দিয়ে জার্নাল পড়ছেন। আমি স্যারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। স্যারের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছি।
স্যার মাথা তুললেন। জিজ্ঞেস করলেন, কোনো বিভাগে পড়ি। বললাম, Mass Communication। জানতে চাইলেন এক বিঘা জমি চাষ করতে একজন কৃষককে কতোটুকু হাঁটতে হয়? আমি বললাম, জানা নেই। স্যার বললেন, তবে ‘ম্যাস’ থেকে ‘এম’ কেটে দাও-যা থাকে তাই কী পড়ছো? দাঁড়ায়, অ্যাস কমিউনিকেশন অর্থাৎ গাধার যোগাযোগ। স্যারের স্যাটায়ার বুঝতে সমস্যা হল না। বললেন, পড়াশোনা কনটেক্সচুয়ালাইজ করতে হবে।
স্যার বললেন, কাছে এসো। তোমার ফেসের ওপর যে জড়ুলটা দেখছি তা কী ছোট-বড় হয়। বললাম সেটা তো খেয়াল করিনি। বললেন চলো, নিচে যাই, সূর্য আলো দরকার। সূর্যের আলোতে আমার জড়ুল পরীক্ষা করলেন এবং বললেন এটি স্থির। ছোট-বড় হলে ক্যান্সারের আশংকা থাকে। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। এ মুহুর্তে অনেক ছাত্র-ছাত্রী স্যার ঘিরে ধরলো।
একজন শিক্ষার্থী জানতে চাইলো, সে সমাজকর্মে পড়ে, সমাজকর্মের ভবিষ্যৎ কী? স্যার বললেন, বিপদ-আপদে পড়লে মানুষ কোনো সমাজকর্মীর কাছে গেছে শুনিনি। জানি না তোমার ভবিষ্যৎ কী? মানুষ বিপদ-আপদে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের কাছেই যায়।
ড. এবনে গোলাম সামাদের সঙ্গে কথা বলা সেই সময় নিরাপদ ছিল না। স্যার আমাদের সেটা মাঝে মাঝে স্মরণ করিয়ে দিতেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে নিরুসাহিত করতেন। বলতেন, তাকে ফলো করা হয়। একদিন দুই জনকে দেখিয়ে বললেন, দেখো সন্ধ্যা থেকে পেছন পেছন ঘুরঘুর করছে। এবং তা কতো তীব্র ছিল। ২০০৭ সালে আমার বিয়ের দাওয়াত দেওয়ার জন্য স্যারের বাসায় যাই। স্যার বললেন, আমি গেলে তুমি সমস্যায় পড়বা। তোমাদের জন্য কল্যাণ কামনা করছি। স্যার, তাঁর ছেলেকে ডেকে বললেন, ছেলেটার মুখে কিছু দেওয়ার ব্যবস্থা করো।
বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে নিয়ে অনেকের অস্বস্তি ছিল। অনেকে স্যারকে নব্যরাজাকার, জামাত-বিএনপিপন্থি, ইসলামিস্ট অভিধায় অভিযুক্ত করতেন। কিন্তু আমার কাছে স্যারকে স্থির কোনো মনোভঙ্গির মানুষ মনে হয়নি। তিনি যেমন রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করতেন, তেমন প্রয়োজনীয় প্রশংসাও করতেন।
স্যারের সব রাজনৈতিক বিশ্লেষণের সঙ্গে তখনও আমরা একমত ছিলাম না। স্যারকে নানা প্রশ্ন করতাম। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, আওয়ামীলীগ ও বিএনপির মধ্যে মূল পার্থক্য কী? তিনি বললেন- অনেক পার্থক্য রয়েছে। তবে একটি বলি, ক্ষমতায় যাওয়ার আগে গঠিত একটি রাজনৈতিক দল হলো আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতার যাওয়ার পরে গঠিত একটি রাজনৈতিক দল হলো বিএনপি। পার্থক্যটি বুঝে নাও।
অভিভাবকত্বের হাত
স্যার সাধারণত কোথায় বসতেন না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পছন্দ করতেন। আমি স্যারকে ইনকিলাব অফিসে রাজু ভাইয়ের ওখানে আর সিটি প্রেসক্লাবে কয়েকবার বসতে দেখেছি।
আমার ঘাড়ের ওপর হাত রেখে ঋঁজু হয়ে কথা বলতেন। জানি, এ অভিভাবকত্বের হাত আর কোনো দিন আমাকে স্পর্শ করবে না। যাহোক, একদিন স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম- সুখী হওয়া উপায়? জীবনের সুখী হওয়ার সহজ উপায় কী? স্যার বললেন, অনুশোচনা বোধ জাগ্রত করে এমন কাজ থেকে বিরত থাকা। সম্প্রতি স্যারের এক সাক্ষাৎকারে পড়লাম, নিজেকে বড় না ভাবাই সুখী হওয়ার আরেকটি উপায় হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন।
এরপর স্যারকে আরও প্রশ্ন করতে শুরু করলাম। স্যার বললেন, অতো জেনে লাভ নেই। পৃথিবীতে কত পারসেন্ট মানুষ জানে খাবার কীভাবে হজম হয়? তারপরও খায়। যদি হজম না হতো!
আরেক প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ইগনোরেন্স ইজ পিস অর্থাৎ অজ্ঞতায় শান্তি। এর মর্ম আমি আজও ভেদ করতে পারিনি। কারণ, স্যার সারাজীবন জ্ঞানের সাধনায় লিপ্ত ছিলেন।
জ্ঞান ও প্রজ্ঞা
জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মধ্যে পার্থক্য জানতে স্যারকে প্রশ্ন করেছিলাম। স্যার বলেছিলেন, বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ছাতা নিয়ে বের হচ্ছো এটা জ্ঞান আর আকাশের কোণায় মেঘ জমেছে দেখে ছাতা নিয়ে বের হচ্ছো সেটা প্রজ্ঞা।।
তথ্য ও বার্তা
মাস্টার্সে গবেষণার সময় তথ্য ও বার্তার মধ্যে পার্থক্য নিয়ে সমস্যায় পড়লাম। অনেকের কাছে গেলাম। এমনকি ঢাকা পর্যন্ত আসলাম। কিন্তু যাদের কাছে গেলাম পরিস্কার ব্যাখ্যা পায়নি। ঢাকা থেকে ফিরে স্যারের কাছে গেলাম। স্যার বললেন, সাধারণত সবকিছুই তথ্য আর যেখানে নির্দেশনা থাকে সেটা বার্তা। বললাম, স্যার উদাহরণ দেন। বললেন, ভিটামিন এ-এর অভাবে রাতকানা রোগ হয় এটা তথ্য আর রাতকানা রোগ সারাতে হলে কচুশাক খেতে হবে এটা বার্তা।
আগ্রহটাই প্রধান
স্যার একদিন বললেন, আগ্রহটাই মূল। বলো, উইলভার রাইট ও অলভিল রাইট কোন ইঞ্জিনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন? তারা জাস্ট আগ্রহ থেকে হেলিকপ্টার বানিয়ে ফেললো। টমাস আলভা এডিসনের আবিস্কার হাজারের কাছাকাছি তাও ঔ আগ্রহ থেকে। আগ্রহ থাকতে হয়।
মাটি বাঁচবে তো
আপনারা অনেকে জানেন, স্যার উদ্ভিদ বিজ্ঞানের শিক্ষক। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা চাষাবাদে রাসায়নিক সার ব্যবহার করছো কীনা? বললাম, জি। স্যার বললেন, আমরা মাটির চাহিদা মূল্যায়ন ছাড়াই সার প্রয়োগ করছি, ভূ-উপরস্থিত পানি ব্যবহার করছি। জমির উর্বরতার স্তর খুব গভীরে নয়। মাটির প্রতি এ নির্বিচার আচরণ মানা যায় না। এ মাটি একবার উর্বরতা হারিয়ে ফেললে খাদ্যাভাবে মানুষ মারা যাবে।
কার্ড, মিথ আর প্রাকটিস
একদিন স্যারের কাছে জানতে চাইলাম ধর্মকে ব্যাখ্যার ক্যাটাগরিটা কী? বললেন- কার্ড, মিথ আর প্রাকটিস। মিথ প্রসঙ্গে বললেন, ধর্মীয় টেক্সটগুলোর ভেতর তুমি অনেক মিথোলজিক্যাল এলিমেন্ট পাবে। যেমন- গরু। কার্ডটি বুঝিতে পারিনি। স্যার থাকলে বুঝে নিতাম। সেই সাধ পূরণ হবে না আর।
কাকের জীবন
সোনাদীঘির মোড়ে আলিগড় লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। স্যার আকাশের দিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন। আমার মনে হলো স্যারের রিট্রোসপেক্ট হয়েছে। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, বাবা-মা বেঁচে আছেন? বললাম- জী স্যার। বাবা-মাকে দেখবা। জানো, কাকেরা পরিণত বয়সে অন্ধ হয়ে যায়, তখন তাদের সন্তানেরা বাবা-মাকে খাবার দেয়!!!
ভিডিও সাক্ষাতকার প্রদানকালে এবনে গোলাম সামাদ
স্যারের সঙ্গে কথা হয়েছে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। প্রায় ৩০ বছর পর স্মৃতি থেকে সেগুলো খুঁজে খুঁজে বের করছি। গতকাল রাত তিনটায় ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পর নতুন কিছু বিষয় মনে হলো। আজ শুরু করছি সেগুলো দিয়ে-
কুইজ
ইংরেজি ডিকশনারির নতুন সংস্করণ বের হবে। ডিকশনারি কর্তৃপক্ষ নতুন শব্দ খুঁজছে। সেগুলো তারা অভিধানে যুক্ত করবে। একজন নাকি ইংল্যান্ডের রাস্তায় বড় বড় করে quiz শব্দটি লিখে দিলেন। সকালে মানুষ রাস্তায় quiz শব্দ দেখে জানতে চাইলো quiz শব্দের অর্থ কী? কারো উত্তর জানা ছিল না। সেখান থেকেই quiz শব্দের অর্থ দাঁড়ালো, অজানা।
ফ্রান্সিস বেকন
স্যার একদিন বললেন চিন্তার জন্য ফ্রান্সিস বেকন পড়াটা জরুরি। বেকন বলেছেন- চিন্তা হলো ময়দার মতো। ময়দা দিয়ে যেমন-রুটি, পরাটা, কেকসহ বিভিন্ন জিনিস বানানো যায়। চিন্তাসূত্র সম্পর্কে পরিচয় থাকলে ভাবাটা সহজ হয়।
ইমায়ুল কান্ট
স্যার বললেন, কান্টের ক্যাটাগরাইজেশনটা পারলে পড়ে নিও। সাদৃশ্য ও বৈশাদৃশ্য না জানলে জ্ঞান আসবে না। সাদৃশ্য ও বৈশাদৃশ্যের সঙ্গে রয়েছে সামাজিক ভ্যালুর সম্পর্ক। যেমন-কুকুর ও বাঘ দুটোই স্তন্যপায়ী প্রাণি। মানুষকে কুকুরের বাচ্চা বললে রেগে যায় আর বাঘের বাচ্চা বললে খৃুশি হয়। এটাই হলো পারসেপচুয়াল ভ্যালু।
সব সুন্দরী মেয়েই আমার ছাত্রী
সিটি প্রেসক্লাবে সন্ধ্যাবেলায় স্যার বিবিসির নিউজ দেখছেন। একজন সাংবাদিক স্যারকে জিজ্ঞেস করলেন-স্যার এতো মনোযোগ দিয়ে কী দেখছেন? বললেন, অ্যাংকর তো অনেক স্মার্ট। স্যার, শ্লেষটি ধরতে পারলেন। বললেন- পৃথিবীর সব সুন্দরী মেয়েই আমার ছাত্রী।
নিজের ছাত্র রাকসু ভিপি রাজনীতিবিদ রুহুল কবির রিজভীর সাথে
রিকশা ভাড়া
এক পসলা বৃষ্টি হয়েছে। স্যার বাসায় ফিরবেন। আমরা একটি রিকশা ডাকলাম। রিকশাওয়ালা দুগুণ ভাড়া চাইলো। স্যার বললেন, কোনো বেশি ভাড়া চাচ্ছো? রিকশাওয়ালা বললো, বৃষ্টি পড়ছে না? স্যার বললেন, ধনী-দরিদ্র্যের ভেতর মৌলিক কেনো পার্থক্য নেই; সবাই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।
না খাবো না
স্যারকে বললাম, আজ আপনাকে মিষ্টি খাওয়াবো। স্যার বললেন, খাবো না। কারণ তোমরা এখনও ইনকাম করো না। আমরা (আমি ও হুমায়ুন) বললাম স্যার আমরা একটি প্রজেক্টে কাজ করছি। সামান্য আয় করি। বললেন, ঠিক আছে। তাহলে চা খাওয়া যায়। মাজেদা হোটেলে স্যারকে নিয়ে গেলাম। সাদা রসগোল্লা ও চা খাওয়ালাম। খেতে খেতে বললেন রিজভী (রিজভী আহমেদ-বিএনপির নেতা; স্যার অনেক স্নেহ করতেন বলে জেনেছি) রাজশাহীতে আসলে আমাকে মিষ্টি খাওয়ায়।
অস্থায়ী সরকার, ভারত ও আহমদ ছফা
১৯৭১ সালে স্যার কলকাতায় বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে একটা পর্যায় পর্যন্ত কাজ করেছেন। তিনি জয়বাংলা পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। স্যার বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের অবস্থান তাঁর ভালো লাগেনি। একপর্যায়ে তিনি সব ছেড়ে দেন। এ সময় আহমদ ছফার সঙ্গে স্যারের এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। আহমদ ছফা স্যারের দিকে একবার তেড়ে এসেছিলেন। তা ছিল আহমেদ ছফার একটি লেখার পর্যালোচনা ঘিরে। পরে জেনেছি সেটা ছিল আহমদ ছফার ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ নিয়ে। আহমদ ছফার লেখার কিছু বিষয়ের সঙ্গে স্যার দ্বিমত পোষন করলে, আহমদ ছফা মারমুখী হয়ে উঠেন।
জাগো নমশূদ্র, জাগো বাংলাদেশ
স্যার একদিন বললেন, ভারতে অবস্থানকালে নানাধরনের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে গেছেন। তিনি বললেন, একদিন কলকাতার এক রাস্তায় দেখি ইটের গুড়ি দিয়ে বড় বড় করে লেখা- “জাগো নমশূদ্র, জাগো বাংলাদেশ”। স্যার মুচকি হেসে বললেন, এ স্লোগানের নিচে একজন লিখেছে, দাদা কাঁচা ঘুম ভাঙ্গাবেন না।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ আওয়ামিলীগের প্রবাসী সরকারের মুখপাত্র ‘জয় বাংলা’র সম্পাদকমন্ডলীতে এবনে গোলাম সামাদ।
ইসলামে সংগীত ও চিত্রকলা নিষিদ্ধ নয়
সংগীত ও চিত্রকলা নিয়ে স্যারের একটি লেখা নব্বইয়ের মাঝামাঝি তুমুল ঝড় তুলে। ইসলামিস্টরা স্যারের ওপর রুষ্ট হন। কারণ, স্যার ও লেখায় বলেছিলেন সংগীত ও চিত্রকলা কোনটিই ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। এ সময় তিনি অনেক রেফারেন্স দিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন। দুটি কথা মনে পড়ে; এক. প্রতিটি সৃষ্টি ছবি, সুর আর ছন্দ প্রকৃতির অপরিহার্য অনুসঙ্গ। এগুলো নিষিদ্ধ হয় কী করে?
অন্যপ্রসঙ্গে স্যার বলেছিলেন, ইসলামে বৈরাগ্যবাদের স্থান নেই। ইসলাম একটি প্রাকটিক্যাল ধর্ম। কোরানের রেফারেন্স দিয়ে বললেন ”ইবাদত শেষে তোমরা শস্যখেতে ঝাঁপিয়ে পড়ো”। আরেকটি কথা আমার মনে ধরে আছে স্যার বলেছিলেন, নবীজীর অধিকাংশ হাদিস গ্রীক দর্শন প্রভাবিত। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম এর কারণ কী? বললেন, আরবদের বর্হিবিশ্বের সঙ্গে সংযোগ বিশেষত বাণিজ্য বিষয়ে।
নবীজী প্রসঙ্গে
নবীজী এতিম ছিলেন। আমাদের সমাজে এতিমদের অবস্হান কতোটুকু শক্ত হয় তোমার তো তা জানে। অথচ নবীজী আদর্শ হয়ে গেলেন। স্যার বললেন, বাবাহীন এতিমরা জীবনে সফল হয়। মা হীন এতিমদের জন্য তা চ্যালেঞ্জের।
দুজনের প্রতি সম্মান
দু ব্যক্তিত্বকে স্যারকে বিশেষ সম্মান করতে দেখেছি। একজন ইত্তেফাকের তৎকালীন রাজশাহী প্রতিনিধি জনাব আনিসুর রহমান (প্রয়াত)। স্যার বলতেন, আনিস সাহেবের জানাশোনা ভালো। আরেকজনকে আমি স্যারকে স্যার সম্বোধন করতে দেখেছি তিনি হলেন ম্যাজিস্ট্রট আবদুস সামাদ (জাতীয় চারনেতার একজন জনাব এএইচএম কামারুজ্জামানের ছোট চাচা)। স্যার বলতেন এ শহরে পড়াশোনা জানা মানুষদের মধ্যে তিনি একজন।
সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে
স্যার বললেন, তোমার যদি সাংবাদিকতা করতে চাও ভাষা ভালো শিখে নাও। ইংরেজি প্রসঙ্গে বললেন, অনেকসময় আমার ভুল হয়ে যায়। ৬০ দশকে যখন ফ্রান্সে পড়তে গেলাম। ভাষা শিখে বিষয়গুলো বুঝতে আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে।
ফ্রান্স প্রসঙ্গে
স্যারকে বললাম, ফ্রান্স থেকে চলে এলেন কেনো থেকে যেতে পারতেন। তিনি বললেন, পারতাম। কিন্তু ভালো লাগেনি। কোনো বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর কেও আমাকে এক পা এগিয়ে দেয়নি বা এক কাপ চা অফার করেনি। এটাই হয়তো তাদের রীতি। আমি রাজশাহী শহরে বাড়ি থেকে বের হলে কতো লোক খোঁজখবর নেয়, চা খেতে বলে। এটা আমি উপভোগ করি। আর যেখানে আমি সম্মানিত হই, সেটাই আমার দেশ।
প্রশ্ন
হুমায়ুন একবার স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি কী আল্লাহকে বিশ্বাস করেন? স্যার, সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললেন, কাউকে প্রশ্ন করার আগে উত্তর শোনার মতো মানসিক শক্তি আছে কীনা তা বুঝতে হবে। এরপর হুমায়ুন স্যারকে মহাকর্ষণ, মধ্যাকর্ষণসহ নানাবিধ বিষয়ে প্রশ্ন করতে থাকলো। যেগুলো আমি খুব ভালো বুঝিনি। এসময় স্যার স্যামুয়েল পি হান্টিং-এর বিখ্যাত তত্ত্ব ক্ল্যাস অব সিভিলাইজেশ্যন নিয়ে কথা বললেন। সব আরগুমেন্ট মনে পড়ছে না। ক্ল্যাসের ক্ষেত্রে ধর্ম একটি বিরাট এলিমেন্ট বলে স্যার মন্তব্য করেছিলেন।
মিথ্যা
স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম স্যার, মিথ্যা আবিস্কারের তাৎপর্য কী। স্যার বললেন, সত্য দিয়ে কাজ হয় না বলেই মিথ্যার আবিষ্কার। মিথ্যা বলার ক্ষমতা কেবল মানুষের রয়েছে।
রাজনীতিবিদ
রাজশাহীর রাজনীতি ও রাজনীতিবিদ সম্পর্কে কিছু কথা হলো একদিন। বললেন মিজানুর রহমান মিনু (রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র) আমাকে রাজশাহীর ইতিহাস বিষয়ে একটি বই লিখতে বলেছেন। তার অনুরোধে আমি রাজশাহীর ইতিবৃত্ত বইটি লিখেছি।
পদ্মানদী
ফারাক্কা নদীর পানিবণ্টন সম্পর্কিত বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি হলো। আমরা স্যারকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম। স্যার বললেন, আন্তর্জাতিক কোনো নদীর ওপর বাঁধ দেওয়ার অধিকার কারো নেই। কিন্তু ভারত তা করেছে। কেবল তাই নয় ভারত নিজেদের রাজ্যগুলোর মধ্যে পানিবণ্টনে সমনীতি অনুসরণ করে না। একপ্রসঙ্গে বললেন, বর্ষাকালে পদ্মার যে পানিপ্রবাহ তা থেকে রাজশাহী শহর ১২-১৮ ফিট নীচে। বাঁধ শহরটি বাঁচিয়ে রেখেছে।
দখলি সত্ত বড় সত্ত
একদিন সোনাদীঘির মোড়ে একজন লোক এসে স্যারকে বললেন, একজন আমার জমি দখল করে নিয়েছে। কাগজপত্র আমার। কিন্তু সে জোর করে দখল করেছে। স্যার বললেন, কাগজপত্র আপনার হতে পারে কিন্তু দখলি সত্তই বড় সত্ত। কাগজ থাকা সত্ত্বেও জমি যে আপনার তা প্রমাণ করতে আপনাকে আদালতে যেতে হবে।
রাজশাহী জেলখানা
স্যার বলেছিলেন, ব্রিটিশ আমলে রাজশাহীতে জেলখানা গড়ে তোলা হয়। দাগী সব আসামীদের এখানে রাখা হতো। রাজশাহী কোনোদিন অপরাধপ্রবন এলাকা ছিল না। কেনো ব্রিটিশরা রাজশাহীতে জেলখানা বানালো আমার মাথায় আসে না।
স্যারের শরীর-স্বাস্থ্য
একদিন স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম এখন আপনার বয়স কতো। বললেন, ৭৬ বছর। বললেন কোনো অসুখ নেই। ডায়াবেটিক, ব্লাডপ্রেশার নেই। তবে পরে স্যারের মেরুদণ্ডে ব্যাথার কথা শুনেছি তা থেকে হাল্কা শ্বাসকষ্ট হতো।
লাইব্রেরি
স্যারকে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী কলেজ, বরেন্দ্র জাদুঘর, সোনাদীঘি মোড় ও বিভাগীয় পাবলিক লাইব্রেরি, লক্ষ্মীপুরে বই পড়তে দেখেছি। বিভাগীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে স্যারকে একদিন ফিজিওলজি ওপর পড়তে দেখেছি। বললেন, মেডিকেল সায়েন্স জানাটা খুব জরুরি।
পরিবার নিয়ে স্যারের উদ্বিগ্নতা
স্যার ছেলেমেয়ে নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করতেন। বললেন যথেষ্ট যোগ্য করে রেখে যেতে পারলাম না ছেলেমেয়েদের। আমার অনুপস্থিতিতে কী করে খাবে ওরা।
স্যারের শোয়ার ঘর
একদিন স্যারের বাসায় গিয়েছিলাম। স্যার নিচতলায় থাকতেন। ছোট একটি খাট। পাশে টেবিলের ওপর অনেকগুলো বই। ঘরটি কিছুটা অন্ধকার। কোনো বুকসেলফ চোখে পড়েনি। অত্যন্ত সাদাসিধা জীবন। স্যারের একটি ওভার কোট ছিল। শীতের সময় সেটা পরে সোনাদীঘির মোড়ে আসতেন। স্যারের উচ্চতস ৫ ফিট ৮/৯ ইঞ্চি হবে। সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটতেন।
বাড়ি অ্যাকুয়ার
স্যারকে আমরা এতো উৎকণ্ঠিত কখনও দেখনি। একদিন বললেন, আমার বাড়ি অ্যাকুয়ার করবে সিটি কপোরেশন। রাস্তা প্রশস্ত করবে। আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোথায় উঠবো, কী করবো বুঝতে পারছি না। আমরা বললাম দুশ্চিন্তা করবেন না। স্যার, বললেন আমার তো তেমনকিছু নেই। তোমরা বুঝতে পারছ না।
সত্যি স্যারের বাড়ি অ্যাকুয়ার হয়ে আজ তা অর্ধেক হয়ে আছে।

লেখকঃ
খান মোঃ রবিউল আলম
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষক। প্রায় কুড়ি বছরের অধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন। খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে পড়াচ্ছেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের মিডিয়া ও জার্নালিজম বিভাগে। প্রকাশিত গবেষণাগ্রন্থ সংখ্যা সাতটি।

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ