বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট এবনে গোলাম সামাদের জন্ম দিন ২৯ ডিসেম্বর। ১৯২৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাজশাহী শহরে তার জন্ম। পিতা মৌলবি মোহাম্মদ আলী ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, গীতিকার ও সুরকার। মাতা নসিরন নেসা। দুই বোন ও সাত ভাইয়ের মধ্যে এবনে গোলাম সামাদ হলেন সর্বকনিষ্ঠ। জ্ঞানতাপস এবনে গোলাম সামাদ আমাদের মাঝে আছেন দীর্ঘদিন। অবশ্য দিয়েছেন তার অধিক।
এবনে গোলাম সামাদের স্কুলজীবনের লেখাপড়া ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে। তবে স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট পরীক্ষা দেন বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার ‘বিষ্ণুপুর শিক্ষা সংঘ’(ব্যাপটিস্ট মিশনারি স্কুল) থেকে, ১৯৪৮ সালে। আইএসসি পাস করেন ১৯৫০ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত তেজগাঁও এগ্রিকালচার ইনস্টিটিউট থেকে কৃষি গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড যান। সেখানকার বিখ্যাত লিডস ইউনিভার্সিটি থেকে প্ল্যান্ট প্যাথলজি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা লাভ করেন ১৯৫৫ সালে। এরপর ঢাকায় জুট রিসার্চ ইনস্টিটিউটে চাকরি করেন ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত। আবার উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য ১৯৫৯ সালের শেষ দিকে যান ফ্রান্সে। ১৯৬৩ সালে ফ্রান্সের পুয়াতিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জীবাণুতত্ত্বে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৬৪ সালের ১১ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শিক্ষকতায় যোগদেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতা চলে যান। সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত ‘জয়বাংলা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ফিরে আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। প্রফেসর হিসেবে এবনে গোলাম সামাদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন ১৯৯৫ সালে।
শিক্ষকতার পাশাপাশি সুদীর্ঘ জীবনে সাহিত্য সাধনাও চালিয়ে গেছেন এবনে গোলাম সামাদ। এমনকি ৯১ বছরে পা দিয়েও লিখে যাচ্ছেন। লেখালেখির ক্ষেত্রে কোনো বিশেষণই তার জন্য যথেষ্ট হবে না। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি বাংলাভাষায় ইসলামী শিল্পকলার ওপর প্রথম বই রচনা করেন। জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা শাখায় গভীর আকর্ষণ ছিল এবনে গোলাম সামাদের। শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান, সঙ্গীত, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয়ে গভীর অধ্যায়ন করেছেন এবং এসব বিষয়ে লিখেছেন বহু প্রবন্ধ ও কলাম। তাকে জীবন্ত জ্ঞানকোষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার সর্বব্যাপক অধ্যয়ন, জ্ঞানের গভীরতা এবং সহজ ও বোধগম্যভাবে তা উপস্থাপনের ঈর্ষণীয় ক্ষমতা মানুষকে বিস্মিত করে।
এবনে গোলাম সামাদ যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের তথা চিন্তা ক্ষেত্রের সব শাখাতে সফল বিচরণ করেছেন, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ‘বাংলাদেশ : সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি প্রতিক্রিয়া’ নামকগ্রন্থ। এবনে গোলাম সামাদ যে রাজনৈতিক সচেতনতার প্রতীক পুরুষ তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা এবং আরাকান সঙ্কট’ নামক গ্রন্থে।
এখানে বিশ্লেষিত হয়েছে আমাদের দেশের রাজনীতির উত্থান-পতনের নানা দিক। আর আলোচিত হয়েছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিধন প্রসঙ্গ। এখানে প্রবন্ধ রয়েছে তিরিশের অধিক। আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এবনে গোলাম সামাদের আরো একটি আকর গ্রন্থ হলো ‘বায়ান্ন থেকে একাত্তর’। মুক্তিযুদ্ধের একদম নিবিড় পর্যবেক্ষক ও পরিদর্শক হিসেবে থেকেই এমন বই রচনা করা সম্ভব। তার আলোচনা যতটা বাস্তবধর্মী ততটাই তথ্যনির্ভর। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছেন গতানুগতিক ভাবে নয়, বাস্তবতার নিরিখে। সে ক্ষেত্রে তার আলোচনা হয়েছে অনেকটাই ভিন্ন ও অন্যদের থেকে আলাদা। এ বিষয়ে বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ৯ মাস কলকাতায় অবস্থান ও ‘জয়বাংলা’ পত্রিকা সম্পাদনা।
প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদ লিখেছেন উদ্ভিদের রোগতত্ত্বের ওপর একাধিক বই। জীবাণুতত্ত্বের শিক্ষক এক সময় ঝুঁকে পড়েন নৃ-তত্ত্বের দিকে। তার এই আগ্রহকে আরো উসকে দেয় পাঁরির নৃ-তত্ত্ব জাদুঘর। সেই জাদুঘরে অনেক সময় কাটিয়েছেন তিনি। নৃ-তত্ত্বের ওপর তিনি লিখেছেন আকর গ্রন্থ।
মফস্বল শহরে জীবন কাটিয়েও এবনে গোলাম সামাদ সারা বিশ্বের চলমান বাস্তবতাকে রেখেছেন তার জ্ঞান ও চর্চার আয়ত্তের মধ্যে। আর প্রচার-প্রচারণাকে সারাজীবন এড়িয়ে চলেছেন সযত্নে। তবে নিজেকে কখনো গণবিচ্ছিন্ন করে রাখেননি। বরং অবাধে মিশেছেন সর্বসাধারণের সাথে। ফলে তার চিন্তাচর্চার সঙ্গে কখনো দেশ ও দশের আশা-আকাঙ্ক্ষার দূরত্ব সৃষ্টি হয়নি। দেশের যেকোনো সঙ্কটে তিনি তার পর্যবেক্ষণ ও চিন্তার ফসলকে জনগণের সামনে উপস্থাপন করেছেন সরাসরি ও নির্ভীকভাবে। তিনি দেশ ও জাতির কল্যাণে বুদ্ধিজীবীসুলভ দিকনির্দেশনা দিয়েছেন সবসময়। পরে তিনি এ প্রসঙ্গে আরো লেখালেখি করেন এবং বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, কেবল নৃ-তাত্ত্বিক উপাদান নয়, ইসলামের অনন্য বৈশিষ্ট্য আমাদের জাতিসত্তা গঠনে ও স্বাতন্ত্র্যবোধ সৃষ্টিতে বিশেষ অবদান রেখেছে।
এবনে গোলাম সামাদের প্রকাশিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের তালিকা সাধারণ জিজ্ঞাসু পাঠকের জন্য দেয়া হল : উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব, জীবাণুতত্ত্ব, উদ্ভিদ সমীক্ষা, ইসলামী শিল্পকলা, মানুষ ও তার শিল্পকলা, শিল্পকলার ইতিহাস, বাংলাদেশে ইসলাম, নৃ-তত্ত্বের প্রথম পাঠ, বর্তমান বিশ্ব ও মার্কসবাদ, বাংলাদেশ: সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি প্রতিক্রিয়া, বাংলাদেশের আদিবাসী এবং জাতি ও উপজাতি, বাংলাদেশে মানুষ ও ঐতিহ্য, বায়ান্ন থেকে একাত্তর। এছাড়া আত্মপক্ষ; প্রকাশক: আবিষ্কার পাবলিকেশন, আত্মপরিচয়ের সন্ধানে; প্রকাশক: র্যামন পাবলিশার, বাংলাদেশ : সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি প্রতিক্রিয়া; প্রকাশক: ঝিঙেফুল, মানুষ ও তার শিল্পকলা; প্রকাশক: ম্যাগনাম ওপাস, নৃতত্ত্বের প্রথম পাঠ; প্রকাশক: অনন্যা, বায়ান্ন থেকে একাত্তর, প্রকাশক : পরিলেখ প্রকাশনী (২০১৭), আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা এবং আরাকান সংকট, প্রকাশক : পরিলেখ প্রকাশনী (২০১৮), ইসলামী শিল্পকলা, বাংলা একাডেমি (১৯৭৮), শিল্পকলার ইতিকথা, সমকাল প্রকাশনী, বাংলাদেশে ইসলাম – ঐতিহ্য, বর্তমান বিশ্ব ও মার্কসবাদ।
তার চিন্তা, তার বিশ্লেষণ, তার রাজনৈতিক দর্শন, দেশপ্রেম আগামী প্রজন্মকে সঠিক পথের দিশা দেখাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এবনে গোলাম সামাদের রচিত বই পঠিত হোক অধিক হারে। তার বাস্তবমুখী চিন্তা ও দেশপ্রেম আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে টেকসই গণতন্ত্রের দিকে আর টেকসই স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের দিকে। এবনে গোলাম সামাদ টিকে থাকুন আমাদের মাঝে আরো অনেক দিন।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, ঘাটাইলডটকম।
লেখকঃ মো. আহসান হাবিব, কলামিস্ট ও শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকাশিত মহীয়সী ডটকম নামক সাইটে।