বন্য প্রাণীরা বনে বাস করে। তাই বন না থাকলে বন্য প্রাণীরা বিলুপ্ত হতে থাকে। এককালে বর্তমান বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ছিল বনভূমি। আর তাই বিভিন্ন প্রকার বন্য প্রাণী দেখা যেত বাংলাদেশে। বন বিলুপ্তির সাথে সাথে ঘটছে বন্য প্রাণীর বিলুপ্তি। এটা একটা খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। একটা দেশে মানুষের সংখ্যা বাড়লে বনজবৃক্ষের সংখ্যা কমে। সঙ্কীর্ণ হতে থাকে বনের এলাকা। আবার কোনো কারণে মানুষের বিলুপ্তি ঘটলে সেখানে গড়ে ওঠে বনভূমি।
মেজর জেমস রেনল যিনি প্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি ও তার সংলগ্ন অঞ্চলের মানচিত্র সরেজমিন জরিপ করে অঙ্কিত করেন (১৭৬৪-৭৬ খ্রি:)। তিনি বলেছেন, এখন যেখানে সুন্দরবন, সেখানে এক সময় ছিল বর্ধিষ্ণু জনপদ। কিন্তু মগ জলদস্যুদের অত্যাচারে হয়ে পড়তে থাকে জনশূন্য। গড়ে ওঠে সুন্দরবন। তিনি বলেন, সুন্দরবন অঞ্চল জরিপ করতে গিয়ে ওই অঞ্চলের কাছে বসবাসকারী অনেক বয়স্ক লোক তাকে বলেছেন এ কাহিনী। তারা এ কাহিনী শুনেছেন তাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে; অর্থাৎ সুন্দরবন অঞ্চল খুব বেশি দিন আগে এখনকার মতো বনময় ছিল না। এ অঞ্চল জনশূন্য হওয়ার ফলেই গড়ে উঠতে শুরু করে বন। বন না থাকলে যে বন্যজন্তু থাকে না, তার অনেক ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে। যেমন ঢাকার কাছে মধুপুর বনাঞ্চলে এক সময় বাস করত বন্যহস্তি (Elephas maximus)। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯১৫ সালেও মধুপুর বনাঞ্চলে হাতি ধরা পড়ত। ঢাকা শহরের আরেকটি জায়গার নাম হলো পিলখানা। ফারসি ভাষায় ‘পিল’ মানে হর হাতি, আর ‘খানা’ মানে হর স্থান। পিলখানা বলতে বোঝায় হাতি রাখার জায়গা। বন থেকে হাতি ধরে এনে এখানে রেখে পোষ মানানো হতো। পরে তাদের রফতানি করা হতো নানা জায়গায়। কারো কারো মতে, বর্তমান ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের নাম হওয়ার কারণ, বন থেকে হাতি ধরে ওই পথে ঢাকার পিলখানায় আনা হতো। এখন মধুপুর বনাঞ্চলে আর হাতি নেই। মধুপুর বনাঞ্চল আর আগের মতো গভীর অরণ্যও নয়। বন্যহস্তি এখনো দেখতে পাওয়া যায় চট্টগ্রাম বিভাগের গভীর আরণ্যক অঞ্চলে। ওই অঞ্চলে অরণ্য যত বিলুপ্ত হচ্ছে বিলুপ্তি ঘটছে হস্তিসহ বন্য প্রাণীর সংখ্যা।
এক সময় রাজশাহী অঞ্চলে ছিল বহু জলাভূমি। শীতকালে সাইবেরিয়া থেকে এখানে উড়ে আসত বিভিন্ন ধরনের জলজ অতিথি পাখি। যেমন, মেরু মারাল (Anas platyrhynchos)। এরা উড়ে আসতে শুরু করত হেমন্তের সূচনায়। এরা বিলের পানিতে নামার আগে নামত ধান ক্ষেতে। প্রচুর ধান খেত এরা। কৃষক হতো এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত। তবে বহু লোক জাল পেতে এদের ধরত। ধরে এনে বিক্রি করত বাজারে। মানুষ এদের কিনে এনে গোশত রান্না করে খেত। এদের গোশত রাজশাহী অঞ্চলের মানুষের কাছে ছিল যথেষ্ট প্রিয়। কিন্তু এখন আর এরা আসছে না। কেননা মানুষ বিল থেকে পানি বের করে দিয়ে এখন সেখানে করছে ধানের আবাদ। জলজ অতিথি প্রাণী সাইবেরিয়া থেকে এ অঞ্চলে উড়ে আসা খুবই কমে গেছে। অনেকের ধারণা, শিকার করার ফলে ঘটেছে পাখির সংখ্যা কমে যাওয়া। কিন্তু অনেক পাখি এখন আর দেখা যায় না অন্য কারণেও। অনেক পাখি বাসা বেঁধে ডিম পাড়ত উঁচু গাছের ডালে। কিন্তু মানুষ এ রকম উঁচু বিরাট বৃক্ষ কেটে খড়ি করতে বাধ্য হয়েছে। ফলে কমেছে পাখির সংখ্যা। যেমন চিল (Milvus migrans) আর রাজশাহী অঞ্চলে তেমন দেখা যায় না। কারণ চিল ডিম পাড়ে উঁচু গাছে বাসা বেঁধে; যে রকম গাছ এখন বিরল হয়ে উঠেছে। চিল মানুষের খাদ্য ছিল না। চিলকে তাই শিকারিরা শিকার করে উজাড় করে দেয়নি।
বাঘ (Panthera tigris) এক সময় বাংলাদেশের সর্বত্রই দেখা যেত। কিন্তু এখন আর দেখা যায় না। বাঘ রাজশাহী অঞ্চলে ছিল। অবশ্য রাজশাহী অঞ্চলে সাধারণ বাঘের চেয়ে ছিল চিতা বাঘের (Panthera pardus) প্রাদুর্ভাব বেশি। এ অঞ্চলে দু-এক সময় চিতা বাঘ দেখা গেলেও সাধারণ বাঘ আর দেখাই যায় না। বাঘ এখন দেখা যায় কেবল সুন্দরবন অঞ্চলে। কিন্তু সেখানে বাঘের সংখ্যা এসেছে কমে। পারিতে সম্প্রতি যে জলবায়ু সম্মেলন হলো, তাতে বাংলাদেশের পরিবেশমন্ত্রী ও ভারতের পরিবেশমন্ত্রী সুন্দরবনে বাঘ রক্ষায় একমত হয়েছেন। বাঘ রক্ষায় ভারত ও বাংলাদেশ গ্রহণ করবে যৌথ উদ্যোগ। সুন্দরবনের একটা অংশ পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত। একটি হিসাব অনুসারে সুন্দরবনের আয়তন হলো ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ হলো বাংলাদেশের, বাকিটা ভারতের। বাঘ এই দুই অঞ্চলেই আনাগোনা করে। বনে বাঘের আনাগোনার ওপরে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো বাঘ রক্ষা করতে গিয়ে যদি তাদের সংখ্যা বেড়ে যায় তবে তারা আগের মতোই সুন্দরবনের সন্নিকটের গ্রামে এসে মানুষ ধরে খাবে। সৃষ্টি করবে আগের মতোই বাঘের পেটে মানুষ যাওয়ার সমস্যা। অন্য দিকে সুন্দরবনের বাঘ যেমন বিখ্যাত, সুন্দরবনের চিত্রল হরিণও (Axis axis) বিখ্যাত। বাঘ এই হরিণ ধরে খায়। বাঘ না থাকলে বৃদ্ধি পেতে পারবে চিত্রল হরিণের সংখ্যা। চিত্রল হরিণের গোশত খুবই সুস্বাদু। তা হয়ে উঠবে মানুষের প্রয়োজনীয় আমিষের খাদ্যের অন্যতম উৎস। বাঘ না থাকলে হরিণের বংশ অনেক দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকবে। বাঘ না থাকলে অনেক সহজে মানুষ গিয়ে সংগ্রহ করতে পারবে সুন্দরবনের মৌমাছির বড় বড় চাক থেকে মধু ও মোম। মানুষকে যেতে হবে না আর বাঘের পেটে। সুন্দরবনের অনেক গাছ আমাদের জ্বালানি কাঠ জোগায়। তাদের সংগ্রহ করতেও বাওয়ালিদের পড়তে হবে না বাঘের কবলে। সুন্দরবনের অনেক গাছ আমাদের কাজে লাগে। যেমন গোলপাতার গাছ (Nepa fruticans)। গোলাপাতা দিয়ে ছাওয়া হয় সুন্দরবনসংলগ্ন অঞ্চলের কুঁড়েঘরগুলোর চাল। গোলপাতা দেখতে গোল নয়, দেখতে কতকটা নারকেলগাছের পাতার মতো। গোলপাতার ফলও হয় কতকটা নারকেলের মতোই; যা মানুষ খায়। সুন্দরবনে খেজুরগাছের মতো একরকম গাছ হয়। যার নাম হিনতাল (Phaenix paludosa)। কিন্তু গাছটার কাণ্ড খেজুরগাছের মতো অত মোটা নয়। গাছটির কাণ্ড দিয়ে বানানো হয় সুন্দর লাঠি; যার ওপর ভর দিয়ে বৃদ্ধরা অনেক আয়েশে করতে পারেন চলাফেরা। গোলপাতা আর হিনতালের কাণ্ড সংগ্রহ করতে গিয়ে মানুষকে পড়তে হবে না বাঘের কবলে। বাঘ এক সময় সারা বাংলাদেশেই ছিল। বাঘের ভয়ে মানুষ এতই ভীত ছিল যে, হিন্দুরা করতেন ব্যাঘ্র দেবতার পূজা। যার নাম ছিল দক্ষিণ-রায়। দক্ষিণ-রায়ের পূজার বিবরণ পাওয়া যায় বাংলা মঙ্গলকাব্যে। বাঘের সংখ্যা বেড়ে আবার সৃষ্টি হতে পারে একই রকম ভীতিপ্রদ পরিবেশ।
আমাদের দেশের পরিবেশবাদীরা এ দেশের ইতিহাস সম্পর্কে মনে হয় যথাযথ অবিহিত নন। তারা তাই বন্যজন্তু সংরক্ষণের ওপর দিতে চাচ্ছেন খুবই গুরুত্ব। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯২১-২২ সালের তদানীন্তন বাংলাপ্রদেশ সরকারের হিসাব মতে, বন্যজন্তুর আক্রমণে সে সময়ের বাংলায় ওই বছর মারা যায় ২৭১ জন ব্যক্তি। সাপের কামড়ে মারা যায় চার হাজার ১৬৫ জন। সে বছর বন্যজন্তু ও সাপ মারার জন্য সরকার পুরস্কার দিয়েছিল আট হাজার ১২ জনকে। অন্য বছরের হিসাব আমি জোগাড় করতে পারিনি। তবে আমার মনে পড়ে, আমার ছেলেবেলায় রাজশাহী শহরের মিউনিসিপ্যালিটির স্বাস্থ্য শাখায় বিষধর সাপ মেরে নিয়ে গিয়ে দেখালে সাপপ্রতি দেয়া হতো আট আনা করে। তখন রাজশাহীর বাজারে আটআনা দিয়ে কেনা যেত পাকি পাঁচ সের মোটা চাল। রাজশাহীতে বিষধর সাপ ছিল যথেষ্ট। সবচেয়ে বিষধর সাপ ছিল গোখরো (Naja naja)। এই সাপ আর এখন রাজশাহী শহরে আগের মতো দেখা যায় না। কাছের গ্রামাঞ্চলে কিছু কিছু দেখা যায়। সাপ বিলুপ্ত হচ্ছে বলে দুঃখ পাওয়ার কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। সাপের ভয়ে আমরা ঘুমাতাম উঁচু খাটে। গুঁজে দিতাম মশারি খুব ভালো করে। যাতে সাপ ঢুকে কামড়াতে না পারে। কেবল যে মশার ভয়ে খাটে মশারি টাঙাতান, তা নয়। সাপ এসে এ শহরে অনেককে বিছানাতে ঘুমের মধ্যেও কামড়িয়েছে।
মানুষ একটি সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আর একটি সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। যেমন ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী মশা মারার জন্য ছড়ানো হতো ডিডিটি। ডিডিটি ছড়িয়ে মশা মারায় ম্যালেরিয়া আর আগের মতো একটা বড় ব্যাধি হয়ে নেই। গ্রামবাংলার কৃষকের স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে পেরেছে ম্যালেরিয়া জ্বর আর আগের মতো হচ্ছে না বলে। একটি হিসাবে প্রকাশ, কৃষক আগের চেয়ে ভালোভাবে চাষাবাদ করার ফলে অনেক অঞ্চলে ধানের উৎপাদন বেড়েছে শতকরা ১৫ ভাগ। কিন্তু ডিডিটি ছড়ানোর ফলে উপকারী পতঙ্গরাও মরেছে। যেসব ফসলের ফুলে পরাগায়ন হয় পতঙ্গের দ্বারা, তাদের ফলন কমেছে পরাগায়ন যথাযথভাবে হতে পারছে না বলে। ডিডিটি পাখিদের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু মোটের ওপর ডিডিটি ছড়িয়ে মশা মারায় আমরা হতে পেরেছি উপকৃত। পরিবেশবাদীরা এসব খবর কতটা রাখেন, আমরা তা জানি না। তারা দুঃখ করছেন ডিডিটি প্রয়োগে পাখিরা মারা পড়েছে। বন্ধ হয়েছে বিহঙ্গ-কাকলী। কিন্তু মানুষের কাছে মানুষের জীবনই হলো সবচেয়ে মূল্যবান, যাতে মানুষের বেশি কল্যাণ হবে তাকেই বলতে হবে শ্রেয়। কিছু পাখির মৃত্যু হয়েছে বলে বিলাপ করাকে তাই বিবেচনা করা যেতে পারে না সঙ্গত বলে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, বন্যজন্তু সংরক্ষণ করতে। এর জন্য তারা হরিণের চেয়ে বাঘের ওপর দিচ্ছেন অধিক গুরুত্ব। যেটা দেয়া সঙ্গত হচ্ছে বলে মনে করার কারণ নেই। অনেকে বলছেন, সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে জাহাজ চলাচল করলে, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের হানি হবে। কিন্তু জীববৈচিত্র্যের হানি হবে বলে আমরা সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে জাহাজ চলাচল বন্ধ করতে পারি না। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে নতুন নতুন বন্দর গড়তে হবে, যদি আমরা চাই অর্থনৈতিক দিক থেকে দ্রুত অগ্রসর হতে। বাংলাদেশের পরিবেশমন্ত্রী সুন্দরবনের বাঘ রক্ষার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন। কিন্তু আমাদের দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির জন্য সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে সমুদ্রগামী জাহাজের আসা যাওয়াকে পরিবেশ রক্ষার নামে বন্ধ করা যাবে না। আমরা শুরুতে উল্লেখ করেছি সুন্দরবন চিরকাল ছিল না। মাত্র তিন-চার শত বছর আগেই সুন্দরবনে ছিল জনবসতি। ১৯৬৪ সালে ভারতের সুন্দরবন অঞ্চল থেকে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে সূর্যদেবতার প্রস্তরমূর্তি; যা রাখা হয়েছে কলকাতার বিখ্যাত ভারতীয় মিউজিয়ামে। এ থেকেও প্রমাণিত হচ্ছে যে, সুন্দরবন অঞ্চলে এক সময় জনবসতি ছিল।
দৈনিক নয়াদিগন্ত/২৮ ডিসেম্বর ২০১৫