ইংরেজি ফান্ডামেন্টালিজম Fundamentalism শব্দটির বাংলা এখন সাধারণত করা হয় ‘মৌলবাদ’। ইংরেজিতে ফান্ডামেন্টালিস্ট Fundamentalist বলতে এমন একদল প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টানকে বোঝায়, যারা চার্লস রবার্ট ডারউইনের (১৮০৯-১৮৮৯) বিবর্তনবাদ ও মানুষের আবির্ভাব সম্পর্কিত মতবাদে বিশ্বাস করেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো অঙ্গরাজ্যের যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি আর্থিক অনুদান গ্রহণ করে, তাতে ডারউইনের মতবাদ এখনো সত্য বলে পড়ানো চলে না। যাদের বলা হয় ফান্ডামেন্টালিস্ট, তারা বাইবেলের সব বক্তব্যকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করার পক্ষে। এরা মনে করেন না, বাইবেলের কোনো কথারই রূপক অর্থ করা সম্ভব।
মৌলবাদ কথাটি ইসলামে প্রযোজ্য হতে পারে না। কেননা, মুসলমানেরা বিশ্বাস করেন, কুরআন শরিফের অনেক কথার রূপক ব্যাখ্যা হতে পারে। বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইমাম গাজ্জালির মতে, কুরআন শরিফের সূরা (অধ্যায়) নূরের ৩৫ নম্বর আয়াতের (শ্লোক) হতে পারে ৭০ হাজার রকমের ব্যাখ্যা। মনে রাখতে হবে, আল কুরআনের মোট আয়াতের সংখ্যা হলো ছয় হাজারের ওপরে। তাই কুরআন শরিফের অনেক কথার অনেক রকম অর্থ করতে পারেন বিজ্ঞজনেরা তথা মুজতাহিদ ব্যক্তিরা। অর্থাৎ যে অর্থে খ্রিষ্টানদের বলা যেতে পারে মৌলবাদী; মুসলমানদের সে অর্থে মৌলবাদী বলা যেতে পারে না। কেননা, মুসলমানদের ধর্মে ধর্মীয় চিন্তার স্বাধীনতা ও ব্যাখ্যাদানের স্বাধীনতা স্বীকৃত।
ইসলামি বিচারব্যবস্থায় বিচারের সময় পরিস্থিতিকে বিবেচনা করতে বলা হয়েছে। যেমন- খলিফা উমর রা: বলেছেন, দুর্ভিক্ষের সময় খাদ্যচুরির জন্য হাত কাটা চলবে না। কেননা, এ সময় ক্ষুধার তাগিদে খাদ্য চুরি অনেক স্বাভাবিক। আল কুরআনে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে খাদ্য দান করতে বলা হয়েছে। ইসলামে কেবলই বলা হয়নি পরকাল সম্পর্কে। ইসলাম একটি ইহজাগতিক ধর্ম। আল কুরআনে তাই বলা হয়েছে, ‘ধন কেবল ধনীদের মধ্যে সঞ্চারিত হতে দেয়া যাবে না।’ (সূরা ৫৯, আয়াত ৭)। ইসলামে বলা হয়েছে মানবসমতার কথা। মুসলমানেরা সাধারণভাবে মনে করেন, আল্লাহর আইন চাই আর সেই সাথে সৎ লোকের শাসন চাই। কুরআন শরিফের সূরা ইউসুফে বলা হয়েছে, মিসরের অনেক রাজা বা ফারোয়াদের থাকত ধর্মগোলা। যেখানে ফসল জমা করে রাখা হতো। দুর্ভিক্ষের সময় এই ফসল বিতরণ করা হতো দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজাদের মধ্যে। মিসরের এক ফারাও ইউসুফ নবীকে দুর্ভিক্ষের সময় ফসল বিতরণের ভার দিয়েছিলেন। কেননা, ইউসুফ নবী প্রসিদ্ধ ছিলেন সৎ লোক হিসেবে। দুর্ভিক্ষের সময় দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মধ্যে খাদ্য বিতরণ হলো আল্লাহর আইন। কিন্তু খাদ্য বিতরণ যদি সৎ লোক দিয়ে না হয়, তবে তা কখনো যথাযথ হতে পারে না। মুসলমানেরা তাই বলেন, আল্লাহর আইন চাই। কিন্তু সেই সাথে প্রয়োজন হলো সৎ লোকের শাসন। এ হলো ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম মূলনীতি। ইসলামের ক্ষেত্রে যদি মৌলবাদ কথাটি প্রয়োগ করতে হয়, তবে সেটি এই বিশেষ অর্থে প্রয়োগ করা উচিত। অর্থাৎ খ্রিষ্টান ধর্মে যে অর্থে মৌলবাদ কথাটি প্রয়োগ করা হয়, সে অর্থে নয়।
আল কুরআনে বলা হয়েছে, ক্ষুধার জন্য ভয় না পেতে এবং সন্তানদের হত্যা না করতে। কেননা, বিরাট সমুদ্র পড়ে আছে। তাতে আছে মৎস্যসম্পদ। সমুদ্রের এই মৎস্যকে শিকার করলেই আহার্য পাওয়া যাবে। এখন আমরা শুনছি নীল অর্থনীতির (Blue-Economy) কথা। অর্থাৎ সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার কথা। ইসলামে সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতির কথা যথেষ্ট আগেই বলা হয়েছে। (সূরা ৫, আয়াত ৯৯)।
মানুষ কেবল একটি পাকস্থলী নিয়ে জন্মায় না; সে এক জোড়া হাত নিয়েও জন্মায়। আর সেই হাত কাজে লাগিয়ে নিজের আহার্য নিজেরাই উৎপাদন করতে পারে। কুরআন শরিফে বলা হয়েছে, আল্লাহ আদমকে কাদামাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন। তারপর তিনি তার মধ্যে প্রবিষ্ট করে দেন তার আপন নিশ্বাস। (সূরা সাদ)। একে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়- আল্লাহ মানুষকে প্রদান করেছেন তার সৃষ্টিশক্তির অংশ, যা সে কাজে লাগিয়ে নিজের জীবন ও ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারে। তাই মানুষকে এই সৃজনশক্তি কাজে লাগিয়ে আপন সমস্যা সমাধান করে বেঁচে থাকতে হবে। এটিই ইসলামের মৌল বিশ্বাস।
বাংলাদেশে ইসলামি মৌলবাদী দল বলতে অনেকে এখন বোঝাচ্ছেন জামায়াতে ইসলামীকে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী দলের প্রতিষ্ঠাতা নেতা মাওলানা সৈয়দ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯০৩-১৯৭৯) ১৯৬৫ সালে আন্দোলন করেছিলেন প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের ধারণার বিরুদ্ধে পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। তার এই গণতন্ত্রের ধারণা ছিল ব্রিটিশ গণতন্ত্রের কাছ থেকে পাওয়া। তিনি কোনো ইসলামি গণতন্ত্রের কথা বলেছিলেন না। তিনি পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সমর্থন করেছিলেন ফাতেমা জিন্নাহকে। ফাতেমা জিন্নাহ ছিলেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন।
ফাতেমা জিন্নাহ ছিলেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতোই শিয়া মাজহাবভুক্ত। কেবল তাই নয়, এই বিশেষ শিয়া মাজহাব খাতেমুন নবুওয়াতের আস্থাশীল নয়। বুখারি শরিফে বলা হয়েছে, নারীরা দুর্বল। তারা খলিফা হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। কিন্তু তথাপি মওদূদী সমর্থন জানিয়েছিলেন ফাতেমা জিন্নাহকে। তার দল জামায়াতে ইসলামী আন্তরিকভাবেই নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছিল ফাতেমা জিন্নার পক্ষে। ফাতেমা জিন্নাহ নির্বাচনে জয়ী হতে পারেননি। কিন্তু তার পক্ষে পড়েছিল অনেক ভোট। আর এই ভোট পাওয়ার একটি কারণ ছিল জামায়াতে ইসলামী দলের নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা। জামায়াতে ইসলামী যদি একটা গোঁড়া মৌলবাদী দল হতো, তবে এটি কখনোই গণতন্ত্রের জন্য এ রকম আন্দোলনে শরিক হতো না। সমর্থন করত না নারী নেতৃত্বকে।
বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী একটি শক্তিশালী দল ছিল না। কিন্তু বর্তমানে তা একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। বিখ্যাত ব্রিটিশ ম্যাগাজিন ইকোনমিস্টের মতে, জামায়াতে ইসলামী এখন হলো বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। কেন বাংলাদেশ হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামী এতটা রাজনৈতিক শক্তি সঞ্চয় করতে পারল, সেটি নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তা করা উচিত।
বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম ছিলেন একজন ভাষাসৈনিক। পরে তিনি ১৯৭১ সালে অভিমত দিয়েছিলেন, শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে। তবে তিনি কখনোই ছিলেন না ভারতীয় আধিপত্যবাদের অনুকূলে আর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে। জামায়াতের বর্তমান রাজনৈতিক শক্তি সঞ্চয়ের একটি কারণ হলো, বাংলাদেশ হওয়ার পর ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরোধিতা করা। ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরোধী দল হিসেবেই সে পেরেছে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে। ১৯৭০-এর নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী পূর্ব পাকিস্তান থেকে কোনো আসনেই জয়লাভ করতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশ হওয়ার পর এটি অনেক আসনেই জয়লাভে সমর্থ হতে পেরেছে; যেটা লক্ষ করার মতো। আর তার ক্ষেত্রে ওঠেনি নির্বাচনে কোনো কারচুপি করার অভিযোগ। গোলাম আযমকে বলা হয়েছিল তিনি বাংলাদেশের নাগরিক নন। কিন্তু বাংলাদেশের বিচার বিভাগ তাকে বাংলাদেশের নাগরিক বলে ঘোষণা করেছে। যেটা ছিল তার জনপ্রিয়তার অন্যতম পরিচায়ক।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। কিন্তু জামায়াত বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করতে হবে বলে কোনো আন্দোলন করেনি। বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৮ সালের ৭ জুন অষ্টম সংশোধনী বিল পাসের মাধ্যমে। তবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে এ জন্য কেউ বলেননি মৌলবাদী। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে গ্রহণ করেছিলেন মালয়েশিয়ার অনুসরণে। বাংলাদেশের অনেক আগেই মালয়েশিয়া ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে মেনে নিয়েছিল। ইন্দোনেশিয়া একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। এটি এখনো ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেনি। কিন্তু ভবিষ্যতে এটিও ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া মিলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গঠিত হতে পারে একটি বিশেষ প্রতিরক্ষা জোট, কতকটা সাবেক সিয়াটোর আদলে।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে তাই বলা চলে এ ক্ষেত্রে একজন দূরদর্শী নেতা। যদিও অন্য ক্ষেত্রে আমরা করতে পারি তার সমালোচনা। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি এখনো করছে না ভারতের প্রতি অনুরক্তি প্রদর্শন। আওয়ামী লীগ বলছে, ভারতের সহযোগিতায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে। কিন্তু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আওয়ামী লীগে কিছুটা ঢুকে পড়লেও এতটা ভারতপ্রীতি প্রদর্শন করছেন না। কী করে আওয়ামী লীগ ভাবতে পারছে ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশের আর্থিক উন্নয়নের কথা, সেটি অনেকেরই বোধগম্য হতে পারছে না। বিশেষ করে যখন ভারতের বিজেপি সরকার ১২-১৩ লাখ বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানকে তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছে আসাম থেকে বাংলাদেশে। কারণ, এভাবে বাংলাদেশে আসাম থেকে মানুষ ঠেলে দিলে, এখানে সৃষ্টি হবে এক বিরাট মানবিক বিপর্যয়; যেটা সাধারণ বুদ্ধিতেই অনুমান করা চলে। ভারতের বিজেপি দল একটি হিন্দুত্ববাদী দল।
কিন্তু তাকে কেউ বলছে না হিন্দু মৌলবাদী দল। ভারতের পত্রপত্রিকায় মৌলবাদী শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে কেবল বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দলগুলোকে চিহ্নিত করতে। ধর্ম পৃথিবীর নানা দেশেই রাজনীতিতে এখনো প্রভাব বিস্তার করে চলেছে, কেবল বাংলাদেশেই নয়। যেমন- ইউরোপের অনেক দেশেই এখনো আছে খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী দল। জার্মানির চান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল হলেন একজন খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী। কিন্তু তাই বলে কেউ তাকে বলতে চাচ্ছেন না তিনি একজন খ্রিষ্টান মৌলবাদী। তাই ‘মৌলবাদ’ কথাটি ব্যবহার করার সময় যথেষ্ট সতর্ক হওয়া উচিত।
দৈনিক নয়াদিগন্তে ২০১৯ সালে প্রকাশিত।