বাংলাদেশের মরুকরণ নিয়ে আলোচনা আরম্ভ হয় ভারতের ফারাক্কা ব্যারেজ চালুর পর। বাংলাদেশের মানুষ উদ্বিগ্ন হয়, কারণ পদ্মা নদী দিয়ে আর আগের মতো পানি আসতে পারবে না। আর এই নদীর পানির অভাব বাংলাদেশকে মরুময়তা প্রদান করতে চাইবে। কিন্তু এখন শোনা যাচ্ছে চীন তিব্বতে সাংপো নদীর ওপর ব্যারেজ (ভেড়িবাঁধ) নির্মাণ করতে যাচ্ছে। যার লক্ষ্য হলো পানি সেচন করে তিব্বতে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি। সাংপো হলো ব্রহ্মপুত্র নদের তিব্বতী নাম। সাংপো থেকে চীন পানি নিয়ে নিলে ব্রহ্মপুত্র নদে হবে পানির অভাব। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পানি আসে ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে। ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে পানি আসা কমে গেলে বাংলাদেশে বাড়বে পানির অভাব। সৃষ্টি হবে মরুময়তার আরো সুযোগ। তাই বিষয়টি হয়ে উঠেছে অনেক চিন্তক ব্যক্তির উদ্বেগের কারণ।
মরুভূমির সৃষ্টি হয় কেন, এই নিয়ে অনেক মত আছে। একটি মত হলো, মরুভূমিতে বৃষ্টিপাত হয় খুব কম। আর তাই গাছপালা হতে পারে না। সৃষ্টি হয় মরুভূমি। সর্বনিম্ন বৃষ্টিপাত হতে দেখা যায় মরুভূমি অঞ্চলে। ভারতের উত্তর-পশ্চিম ভাগে এবং বর্তমান পাকিস্তানের দক্ষিণ-পূর্ব ভাগে বালুকাময় থর মরুভূমি অবস্থিত। এই মরুভূমি সিন্ধু উপত্যকায় বহু দূর প্রবেশ করেছে। সিন্ধু নদ বিরাট। সিন্ধু নদ প্রবাহিত হয়েছে সিন্ধু প্রদেশের মধ্য দিয়ে। একে কেন্দ্র করে তাই উদ্ভব হতে পেরেছিল মহেঞ্জোদারোর মতো সভ্যতার। কিন্তু সিন্ধু নদ থেকে পূর্ব দিকে কিছু দূর গেলেই আরম্ভ হয় বালুকা ময় থর মরুভূমি। যেখানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১২ সেন্টিমিটারের কম।
পৃথিবীর বৃষ্টিপাতের মানচিত্র দেখলে দেখা যায় যে, গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের যেসব জায়গায় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের গড় পরিমাণ ২৫ সেন্টিমিটারের কম, সেসব জায়গায় মরুভূমি সৃষ্টি হতে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো অঞ্চলেই বার্ষিক বৃষ্টিপাতের গড় পরিমাণ এত কম নয়। সর্বত্রই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১০০ সেন্টিমিটারের বেশি। যেসব গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমান ১০০ থেকে ২০০ সেন্টিমিটারের মধ্যে, সেসব অঞ্চলে দেখা যায় পাতা ঝরা গাছেন বন। পাতাঝরা গাছের বিশেষ দৃষ্টান্ত হলো শাল। একসময় বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ছিল শালগাছের বন। মানুষ এই বনভূমি পরিষ্কার করে শুরু করে ক্ষেত-খামার। এ হলো আমাদের কৃষি অর্থনীতির ইতিহাস।
অনেক গাছ আছে যাদের পাতা ঝরে মাটিতে যথেষ্ট পানি না থাকার কারণে। কিন্তু এরা যদি এমন জায়গায় জন্মায় যে, বছরের কোনো সময়ই মাটিতে পানির অভাব হয় না। তবে এখানে তারা পরিণত হয় চিরসবুজ গাছে। বাতাসে আর্দ্রতার অভাব হলেও অনেক গাছের পাতা ঝরে। কেননা গাছপালা চায় পানির অভাব মোকাবেলা করতে। কিন্তু মরুভূমিতে পানির এতই অভাব যে, এখানে গাছপালা হয় না। হলেও হয় সামান্য; কাঁটা ঝোপঝাড়।
বাংলাদেশে তিন রকম বনভূমি দেখা যায়। পাতাঝরা শাল অরণ্য। দেখা যায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের চিরসবুজ অরণ্য। যার বৈশিষ্ট্যসূচক গাছ হচ্ছে গর্জন। বাংলাদেশে সমুদ্রের ধারে হতে দেখা যায় জোয়ার অরণ্য। যারা বাঁচতে পারে সমুদ্রের নোনা পানিতে। কারণ এসব অঞ্চল জোয়ারের সময় সমুদ্রের নোনা পানিতে ভরে যায়। এসব গাছের পাতা ঝরে না। এরাও চিরসবুজ গাছ। বাংলাদেশে প্রধানত দুই রকমভাবে বৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের উত্তরে আছে হিমালয় পর্বতমালা। বাংলাদেশের পুবে আছে আসামের খাসিয়া-জয়ন্তিয়া পাহাড়। এসব পাহাড়ে জলীয়বাষ্পপূর্ণ দক্ষিণ-পশ্চিম মওসুমি বাতাস ধাক্কা খেয়ে দ্রুত উপরে উঠে ঠাণ্ডা হয়। এর ফলে এর মধ্যে থাকা জলীয়বাষ্প পরিণত হয় মেঘে। মেঘ থেকে হয় প্রচুর বৃষ্টি। এরকমভাবে বৃষ্টি হওয়াকে বলে শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টি। বাংলাদেশে বর্ষাকালে যে বৃষ্টি হয় তার সবটাই হলো এই রকম বৃষ্টি।
অন্য দিকে এপ্রিল-মে মাসে (চৈত্র-জ্যৈষ্ঠ) যে বৃষ্টি হয়, তাকে বলে পরিচলন বৃষ্টি (ঈড়হাবপঃরড়হ জধরহ)। বাংলাদেশে যেহেতু নদীর পানি আর আগের মতো আসবে না, তাই খাল-বিল শুকিয়ে যাবে। পরিচলন বৃষ্টি হয় গ্রীষ্মকালে খাল-বিল, নদী-নালা থেকে সৃষ্ট জলীয়বাষ্পপূর্ণ বাতাস থেকে। জলীয়বাষ্পপূর্ণ বাতাস শুষ্ক বাতাস থেকে হালকা। তাই তা চার দিকে শুষ্ক ভারী বাতাসের চাপে উঠতে থাকে ঊর্ধ্বমুখে।
আমাদের দেশে পানি সমস্যার সমাধান করতে হলে এখন তা করতে হবে বর্ষাকালের বৃষ্টির পানি ধরে রেখে। এ ছাড়া অন্য কোনোভাবে আমাদের পানি সমস্যার সমাধান করা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। আমাদের দেশে সরকারিভাবে গভীর নলকূপ স্থাপন করে সেচব্যবস্থা করা হয়েছে। যাকে বলা হয় ভূগর্ভস্থ পানি, তা সৃষ্টি হয় বৃষ্টির পানি মাটির নিচে চুইয়ে গিয়ে জমা হয়ে। গভীর নলকূপের সাহায্যে যদি এত পানি তোলা হয় যে, যা মাটির মধ্যে বৃষ্টির পানিতে সঞ্চিত হতে পারে না, তবে ভূগর্ভস্থ পানির অভাব দেখা যায়। সৃষ্টি করে পানীয় পানির অভাব। কতকটা মরুভূমি অঞ্চলেরই মতো। গভীর নলকূপের সাহায্যে সেচব্যবস্থা দেশকে করে তুলতে পারে মরুময়।
আমরা দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর কথা অনেক শুনছি। ফারাক্কা হওয়ার ফলে পদ্মা নদী দিয়ে পানি আর আগের মতো আসছে না। দ্বিতীয় পদ্মা সেতু করলে তাতে ধাক্কা খেয়ে পাদ্মার পানিপ্রবাহ আরো মন্থর হয়ে পড়বে। পদ্মা নদীতে আরো দ্রুত পড়তে থাকবে চর। পদ্মা হয়ে উঠবে আগের তুলনায় একটা মরা নদী। নদীকে রক্ষা করার জন্য এখন অনেক দেশেই নদীর ওপর আর সেতু নির্মাণ না করে, নদীর নিচ দিয়ে গড়া হচ্ছে সুড়ঙ্গ। পদ্মা সেতু তৈরি করে পদ্মা নদীর আরো ক্ষতি কেন করা হচ্ছে, সেটা আমাদের অনেকের কাছে মোটেও বোধগম্য নয়।
দেশের মধ্যে হওয়া উচিত নদী বাঁচাও আন্দোলন। দেশবাসীকে হতে হবে পানিসচেতন। আগে যার প্রয়োজনীয়তা ছিল না। কিছু দিন আগে রাজশাহী শহরের কাছে অবস্থিত ললিতনগর নামক জায়গায় পানীয় পানির প্রচণ্ড অভাব দেখা দিয়েছিল, গভীর নলকূপের সাহায্যে অত্যধিক পানি তোলার কারণে। মানুষ তার একটি সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আরেকটি জটিল সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
উচ্চ ফলনশীল ধান লাগাতে গিয়ে এখন জমিতে দেখা দিয়েছে গাছের খাদ্য উপাদান ঘাটতির সমস্যা। যেমন আমাদের দেশে মাটিতে আগে ধানগাছ লাগাতে হলে, দস্তাঘটিত সার দিতে হতো না; কিন্তু এখন অনেক স্থলেই দস্তাঘটিত সার না দিয়ে ধান হচ্ছে না। সাধারণভাবে উচ্চ ফলনশীল ধান মাটি থেকে আমাদের সনাতন ধানের তুলনায় ১৩ গুণ বেশি খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে। সার না দিলে এখন মাটিতে কোনো খাদ্যশস্যই উৎপাদিত হতে পারছে না। উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদ হয়ে উঠেছে অনেক খরচের ব্যাপার। আমাদের সনাতন ধান এর চেয়ে অনেক কম খরচে আবাদ করা যেত। আর যেহেতু আবাদে খরচ পড়ত কম, তাই তা বেচে যে লাভ হতো সেটা ছিল অনেকের মতে তুলনামূলতভাবে বেশি।
আমরা আলোচনা করছিলাম মরুময়তা নিয়ে। সব ফসল হতে এক রকম পানি লাগে না। অনেক ফসল অনেক কম পানিতে আবাদ করা যেতে পারে। যেমন চিনা, কাওন, বাজরা। এখন এসব ফসলের চাষ বাড়ানো যায় কি না, সে চেষ্টা আমাদের গ্রহণ করতে হবে। অনেক পরিমাণে বদলাতে হবে আমাদের খাদ্যাভ্যাস।
বাংলাদেশ ভাটির দেশ। এমনিতেই ভাটির দেশের মানুষ পানির জন্য উজানের দেশের ওপর বেশ কিছুটা নির্ভরশীল হতে বাধ্য হয়। আমরাও হচ্ছি। এ ছাড়া বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে একটা শক্তিশালী রাষ্ট্র নয়। সে শক্তি প্রয়োগ করে অন্যের কাছ থেকে পানিসম্পদের অংশ আদায় করে নিতে সক্ষম নয়। তা ছাড়া নদীর পানি যদি আন্তর্জাতিক প্রথা অনুসারে ভাগ করা হয়, তথাপি বাংলাদেশ নদীর পানি আর আগের মতো কখনোই পাবে না। এটাও মনে রাখতে হবে।