ইকবাল (১৮৭৩-১৯৩৮) আমাদের কাছে উর্দু কবি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। কেননা, ইকবালের মোট কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১১টি। এগুলোর মধ্যে তিনটি উর্দু ভাষায় রচিত। আর বাকি আটটির ভাষা ফারসি। ইকবাল তার প্রথম জীবনে কবিতা লিখেছেন উর্দুতে। কিন্তু পরিণত জীবনে কবিতা লিখেছেন ভারসি ভাষায়। ইকবালের দু’টি কাব্যগ্রন্থ বিশেষভাবে খ্যাতি লাভ করেছে। একটি হলো, ‘আসরার-ই-খুদী’ (১৯১৫) আর অপরটি হলো ‘জাভিদনামা’ (১৯৩২)। এ দু’টি গ্রন্থই ফারসি ভাষায় রচিত, উর্দু ভাষায় নয়। ১৯২০ সালে R A Nicholson আসরার-ই-খুদীর ইংরেজি অনুবাদ করেন। নিকলসানের অনুবাদ পড়ে ইউরোপ জানতে পারে ইকবালের নাম। নিকলসান আসরার-ই-খুদীর অনুবাদ করেন Secrets of the Self নামে। আসরার-ই-খুদীর নাম অনেকে বাংলায় দিতে চান ‘আমিত্বের দর্শন’। কেউ কেউ বলেন ‘কর্মযোগ’। তবে আমিত্বের দর্শন নামটা বেশি প্রচলিত হতে পেরেছে। মানুষ অনুভব করে, চিন্তা করে, সংকল্প করে। সংকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ফুটে ওঠে আমিত্বের পরিচয়। বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ দেকার্থ (১৫৯৬-১৬৫০) বলেছেন, মানুষ চিন্তা করে, তাই সে আছে। মানুষ হলো চিন্তা করার কর্তা। সব কিছুর অস্তিত্ব অস্বীকার করা যেতে পারে; কিন্তু মানুষের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যেতে পারে না। কেননা যে চিন্তা করছে সে নিশ্চয়ই আছে, না হলে চিন্তা করবে কে? ডেকার্থের মতে, মানুষ মানুষ, কেননা সে চিন্তা করে, কাজ করে। চিন্তাভাবনা দিয়েই পরিচালিত হতে হবে মানবজীবন। ডেকার্থ ছিলেন বুদ্ধিবাদী দার্শনিক। অন্য দিকে জার্মান দার্শনিক নিৎসে (১৮৪৪-১৯০০) বলেন, ‘মানুষ আছে, কেননা সে সংকল্প করে। সংকল্পের বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে প্রতিটি মানুষের আমিত্বের পরিচয়। মানুষ তাই, যেভাবে সে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে।’ ইকবাল তার আমিত্বের ধারণার েেত্র নিৎসের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। আসরার-ই-খুদীতে তিনি বলেছেন :
জীবনের মর্ম নিহিত রয়েছে কর্মের মধ্যেই
সৃষ্টিতে আনন্দ পাওয়া জীবনের ধর্ম
ওঠো, নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করো।
ইকবালের মতে, মানুষ মনোবান প্রাণী। মানুষের মন অনুভব করে, চিন্তা করে এবং সংকল্প করে। মনের কাজ হলো এই তিনটি। ইকবাল সংকল্পের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন।
‘জাভিদনামা’ বইটির নাম এসেছে ইকবালের কনিষ্ঠ পুত্রের নাম থেকে। ইকবাল তার এই পুত্রকে খুব স্নেহ করতেন। জাবিদনামা বইটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে The Pilgrimage of Eternity নামে। জাভিদনামা বইটি লেখা হয়েছে কতকটা ইটালির কবি দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’র (দি ভিন কমিদিত্তা) অনুসরণে। ডিভাইন কমেডিতে দান্তে স্বর্গ ও নরক পরিভ্রমণ করেছেন। স্বর্গ ও নরকে যাদের তিনি দেখেছেন, বলেছেন তাদের কথা। স্বর্গ ও নরকে দান্তেকে পথ দেখিয়েছেন লাতিন কবি ভার্জিন। আর ইকবালকে উপগ্রহ ও গ্রহলোকে পথ দেখিয়েছেন ফারসি কবি জালাল-উদ-দীন-আল রুমী। জাভিদনামায় ইকবাল ভ্রমণ করেছেন চাঁদে বুধ, মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহে। চাঁদে এবং এসব গ্রহে তিনি যাদের দেখেছেন এবং যা দেখেছেন, করেছেন তার বর্ণনা। যার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে তার জীবনদর্শন ও নানা বিষয়ে ধ্যানধারণ। মঙ্গলগ্রহের একটি শহরের নাম দিয়েছেন মর্ঘদিন। যে শহরের বাসিন্দাদের জীবন তার কাছে মনে হয়েছে আদর্শ হিসেবে গ্রহণীয় বলে। তিনি মর্ঘদিনের সমাজজীবনের বর্ণনা করেছেন এভাবে,
যন্ত্রদানবের এমন জোর নেই করবে প্রকৃতিকে পালন
আকাশ সেই দেশে ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার নয়,
কেবল খাটছে যে কিষান, পাচ্ছে সে
প্রদীপে উজ্জ্বল আলো
তাদের নেই কোনো জমির মালিকের ভয়।
তাদের কৃষিকাজ সে নয় নিশিদিশি
জলের চিন্তায় ¤øান
তাদের ফসলে তো অন্য কারো নেই হাত
সে দেশে কোনোখানে সৈন্য নেই কোনো,
নেই বা ব্যূহ নির্মাণ
খুনে বা সংঘাতে তাদের জুটছে না ভাত।
মিথ্যে লেখা আর মিথ্যে রটনার ছলে
মর্ঘদিনে কোনো লেখক মর্যাদা পান না
বাজারে বেকারেরা ভরে না পথ কোলাহলে
কানের পীড়া নেই আর্ত ভিখিরীর কান্নায়।
ওপরে ইকবালের কবিতার যে বাংলা দেয়া হলো, সেটা করেছেন পশ্চিম বাংলার খ্যাতনামা কবি সঙ্খঘোষ। তিনি ১৯৯৫ সালে কলকাতার যুগান্তর পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় একটি প্রবন্ধ লেখেন ‘কেন ইকবাল’ নামে। তার এই প্রবন্ধ পশ্চিমবঙ্গে ইকবাল সচেতনতা সৃষ্টিতে সাহায্য করে। সঙ্খঘোষ কেবল একজন কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক। বাংলাভাষাভাষী অঞ্চলে ইকবালকে বিশেষভাবে পরিচিত করার প্রথম পদপে গ্রহণ করেছিলেন প্রখ্যাত কবি অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৭)। তিনি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব থাকার সময় ইকবালের সাথে লাহোরে গিয়ে দেখা করেন। এবং ফিরে এসে বাংলা ভাষায় ইকবাল সম্পর্কে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন। অমিয় চক্রবর্তী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের খুবই ঘনিষ্ঠ। কিন্তু তিনি কবিতা লিখেছেন সম্পূর্ণ তার নিজস্ব আঙ্গিকে। তার কবিতার মেজাজ রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে হয়েছে বিশেষভাবেই ভিন্ন। ‘পিঁপড়ে’ বলে তার একটি কবিতা আছে। এই কবিতার মাধ্যমে তিনি প্রথমে তখনকার কবিতাপ্রেমী পাঠকদের তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হন। কবিতাটির প্রথম স্তবক এই রকম :
আহা পিঁপড়ে ছোট পিঁপড়ে ঘুরুক দেখুক থাকুক
কেমন যেন চেনা লাগে ব্যস্ত মধুর চলাÑ
স্তব্ধ শুধু চলায় কথা বলাÑ
আলোয় গন্ধে ছুঁয়ে তার ওই ভুবন ভ’রে রাখুক,
আহা পিঁপড়ে ছোট পিঁপড়ে ধুলোর রেণু মাখুক
অমিয় চক্রবর্তী আসলে ছিলেন, যাকে বলা হতো রবীন্দ্রোত্তর যুগের কবি। সে সময় রবীন্দ্রোত্তর যুগের কবিদের মধ্যে পাঁচজন কবির নাম খুব শোনা যেত। এরা হলেন : অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ এবং বিষ্ণু দে। এদের বলা হতো পঞ্চ পাণ্ডব। অমিয় চত্রবর্তী ছিলেন খুবই উচ্চ শিতি। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেছিলেন ১৯৩৭ সালে ডি. ফিল ডিগ্রি, ইংরেজি সাহিত্যে গবেষণা করে। অমিয় চক্রবর্তীর ইকবাল নিয়ে আলোচনা তাই বাংলাভাষী সাহিত্যপ্রিয় সমাজে ইকবাল সম্পর্কে জানতে উৎসাহিত করেছিল। অমিয় চক্রবর্তী ইকবালের কয়েকটি কবিতার বাংলা অনুবাদ করেন। ইকবালের ফারসি ভাষায় লিখিত ‘যবুরে আযম’ কাব্য গ্রন্থের একটি কবিতার তিনি অনুবাদ করেন ‘মানব’ নামে :
তুমি তৈরি করেছ রাত্রি, আমি তো জ্বেলেছি আলোক।
মাটি তোমার, তাই দিয়ে রচলাম পানপাত্র।
তোমার ছিল মরুভ‚মি। পর্বত; অরণ্য;
আমার হ’ল তৈরি ফুলের কানন, গোলাপ ফুলের বাগান।
আমি সে, যে ‘পাথর’কে ক’রে দেয় আয়না,
বিষ হতে যে বানায় মধু \
ইকবাল তার এই কবিতায় বোঝাতে চান মানুষের সৃজনী শক্তি আছে। সে তার সৃজনী শক্তির মাধ্যমে প্রকৃতিকে পরিবর্তিত করে বাঁচে। আর সেভাবেই তাকে বেঁচে থাকতে হবে। ইকবালের মূল দর্শন হলো, মানুষ সৃজনী শক্তিসম্পন্ন প্রাণী। তাকে বিচার করতে হবে স্রষ্টার পাশাপাশি একটি সহ-সৃষ্টিশক্তি (Co-worker) হিসেবে। ইকবাল দর্শনের মূল কথা হলো এটাই। ভারতে এখন ইকবাল দর্শনের এই দিকটির ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। তাকে নিয়ে হতে পারছে বিশেষ আলোচনা।
পত্রিকার খবরে প্রকাশ, ৯ মে ২০১৫ পশ্চিবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইকবালকে তার ‘তারানায়ে হিন্দি’ নামক সঙ্গীত রচনার জন্য মরণোত্তর সম্মাননা পুরস্কার দিয়েছেন। ইকবালের পৌত্র ওয়ালিদ ইকবাল কলকাতায় এসে এই পুরস্কার নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ১৯০৫ সালে লিখেন তার সোনার বাংলা গানটি, যা এখন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। ইকবাল তারানায়ে হিন্দ গানটি রচনা করেছিলেন ১৬ আগস্ট ১৯০৪ সালে। যাতে তিনি বলেন :
সারে জাহাঁ সে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা
হাম বুলবুলে হেঁ ইস কী ইয়ে গুলিস্তাঁ হামারা।
তারানা মানে সঙ্গীত। তারানায়ে হিন্দির বাংলা করলে দাঁড়ায় ভারত সঙ্গীত। এর বাংলা করলে দাঁড়ায় : সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দেশ হলো আমাদের এই ভারত। আমরা হলাম এর গানের বুলবুলি। আর এ হলো আমাদের সবার ফুল বাগান…।
কেন এত দিন পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইকবালকে মরণোত্তর সম্মাননা দেয়ার প্রয়োজন অনুভব করলেন আমরা তা জানি না। অনেকে বলছেন, আগামী নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান ভোট পাওয়ার জন্য। আমরা বলতে পারি না। তবে সারা উত্তর ভারতে ইকবালকে নিয়ে কিছু কিছু আলোচনা হচ্ছে। কেবল যে পশ্চিমবঙ্গেই ইকবাল নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, এমন নয়। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন ইকবাল বড় কবি, না রবীন্দ্রনাথ বড় কবি। কিন্তু এ রকম প্রশ্ন তোলা মোটেও বান্তর নয়। কেননা, ইকবালের সাহিত্য আদর্শ আর রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য আদর্শ এক ছিল না। দু’জনে সাহিত্য চর্চা করেছেন ভিন্ন আদর্শ নির্ভর করে। ইকবাল মনে করতেন, যা আছে তার স্থলে যা হওয়া উচিত, সেটা প্রতিষ্ঠা করার জন্য মানুষকে কৃতসংকল্প করাই হলো সাহিত্যের উদ্দেশ্য। অন্য দিকে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, মানুষের অভিজ্ঞতা কেবল জানার বিষয় নিয়ে নয়। সে সুখ-দুঃখ ভোগ করে, ভক্তি ও ঘৃণা অনুভব করে। এসব বোধ নিয়ে তার হৃদয়ের অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতাকেও সে স্মরণীয় রূপ দিয়ে নিজের স্বভাবের পরিচয় দিতে চায়। ভাষার ভেতর দিয়ে সেই স্বভাবকে প্রকাশ করার উপায় সাহিত্য। সাহিত্য মুখ্যত মানুষের জ্ঞানের ভাণ্ডার নয়, বোধের ভাণ্ডার। রবীন্দ্রনাথ ও ইকবালের সাহিত্য দর্শন এক ছিল না। এক পথে অগ্রসর হয়নি তাদের সাহিত্যচর্চার ধারা।
দৈনিক নয়াদিগন্ত/২১ জুলাই ২০১৫