সম্প্রতি মিয়ানমারের একজন বিশিষ্ট অধ্যাপক বলেছেন, রোহিঙ্গা নামটি তিনি ব্রিটিশ শাসন আমলের আরাকানের কোনো ব্রিটিশ দলিলপত্রে থাকতে দেখেননি। রোহিঙ্গা বলে আসলে কিছু নেই। যাদের বলা হচ্ছে রোহিঙ্গা তারা হলো বাংলাদেশ থেকে যেয়ে উপনিবিষ্ট হওয়া চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলের বাংলাভাষী মুসলমান। এরা হলো অভিবাসী। এদের তাই আরাকান থেকে চলে যেতে হবে।
কিন্তু তার এই যুক্তিকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না। কারণ ইংরেজ আমলের দলিলপত্রে রোহিঙ্গা নামটি না থাকলেও পাওয়া যায়, আরাকানি মুসলমানদের হিসাব। ব্রিটিশ শাসনামলে আরাকানে ১৯৩১ সালে যে আদমশুমারি করা হয়, তার হিসাব থেকে দেখা যায় যে, সে সময়ের আরাকানের জনসংখ্যার শতকরা ৩৬ ভাগ ছিলেন মুসলমান। এই জনসমষ্টিকে আমরা রোহিঙ্গা না বলতে পারি, কিন্তু এদের বংশধরদের অবশ্যই ধরতে হবে আরাকানের নাগরিক। কারণ মানুষ নাগরিক অধিকার লাভ করতে পারে সে দেশে জন্মাবার কারণে।
১৯৩১ সালে যেসব মুসলমান আরাকানে ছিলেন তাদের বংশধরকে এখন আরাকানের নাগরিক না বলার কোনো কারণ আছে বলে ধরা যায় না। কেননা তারা এবং তাদের পূর্বপুরুষ জন্মেছেন আরাকানেই। রোহিঙ্গা নামটা ব্রিটিশ শাসনামলের দলিলপাতিতে থাকার কথা নয়। কেননা রোহিঙ্গা নামটা বাংলা ভাষার। ইংরেজি ভাষার নয়। ইংরেজি ভাষায় নামটা গৃহীত হয়নি।
প্রাচীন যুগে সংস্কৃত ভাষায় যে দেশটিকে বলা হতো ব্রহ্ম, ফার্সি ভাষায় তা রূপান্তরিত হয়ে দাঁড়ায় বারহামা। বারহামা নামটা ইংরেজিতে হয়ে দাঁড়ায় বার্মা। বিদেশের সাথে যোগাযোগ রাখার ক্ষেত্রে বর্মি রাজারা একসময় ফার্সি ভাষা ব্যবহার করতেন। ইংরেজদের সাথে তারা যোগাযোগ রক্ষা করতেন ফার্সি ভাষার মাধ্যমে। যার প্রমাণ পাওয়া যায়, ব্রিটিশ-ব্রহ্ম যুদ্ধের সময় লেখা বর্মি রাজার ফার্সিতে লেখা চিঠিপত্র থেকে। যে এলাকাকে আমরা বলি আরাকান, তাকে ফার্সি ভাষায় বলা হতো অখরং অথবা আরাখং। আবুল ফজল তার আইন-ই-আকবরী বইতে দেশটির নাম লিখেছেন অখরং। আর মির্জা নাথান তার ফার্সিতে লেখা বাহারিস্তান-ই- ঘয়বী বইতে দেশটির নাম লিখেছেন আরাখং। আবুল ফজল ছিলেন সম্রাট আকবরের সভাসদ। আর মির্জা নাথান ছিলেন আসামের গৌহাটি শহরের মোগল সুবেদার, অনেক পরে। আরাখং নামটা ইংরেজিতে হয়ে দাঁড়ায় আরাকান।
আমরা বাংলা ভাষায় আরাকান নামটা গ্রহণ করেছি ইংরেজি ভাষা থেকে। আরাকানের প্রাচীন নাম ছিল রাখাইন। দেশটার নাম বার্মার সামরিক সরকার ১৯৬২ সালে আরাকান নামের পরিবর্তন করে, নাম দেন রাখাইন স্টেট। ১৯৮৯ সালের ১৮ জুলাই থেকে বার্মার নাম করা হয়েছে মিয়ানমার। তবে বার্মা নামটা ইংরেজিতে এখনো চলেছে। একেবারে বাদ পড়ে যায়নি। আমরা একসময় বার্মাকে বলতাম বর্মা। যাদের আমরা বলি বর্মি, তারা নিজেদের বলেন ম্রনমা। ম্রনমা থেকে করা হয়েছে মিয়ানমার নামটা। মিয়ানমার নামের ‘র’ বর্মি ভাষায় উচ্চারিত হয় না। যদিও লেখার সময় ‘র’ লেখা হয়। তাই বর্মি ভাষায় মিয়ানমার নামটা উচ্চারিত হয় মিয়ানমা। বর্মি ভাষাকে বলা হয় ম্রনমা। বর্মি ভাষা আমাদের ভাষা থেকে অনেক আলাদা। বর্মি ভাষাকে স্থাপন করা হয় চীনা ভাষা পরিবারে। চীনা পরিবারভুক্ত ভাষায় উপসর্গ, প্রত্যয় ও বিভক্তি নেই।
আমরা যতটুকু শব্দ একত্রে উচ্চারণ করতে পারি ইংরেজিতে তাকে বলে সিলেবল। বাংলায় পাহাড় শব্দটাই দুইটা সিলেবল আছে। ‘পা’ এবং ‘হাড়’। চীনা পরিবারভুক্ত ভাষায় সব অর্থবোধক শব্দ হলো একটি করে সিলেবল দ্বারা গঠিত। বর্মি এবং আরাকানি ভাষার শব্দ গঠিত হয় একটি মাত্র সিলেবল দ্বারা এবং এই দুই ভাষার শব্দে কোনো উপসর্গ, প্রত্যয় বা বিভক্তি যুক্ত হয় না। তবে বর্মি ও আরাকানি ভাষা চীনা অক্ষরে লিখিত হয় না। বর্মি ও আরাকানি ভাষার অক্ষর বাংলা ভাষার মতোই ব্রাহ্মী অক্ষর থেকেই উদ্ভূত অক্ষর দ্বারা লিখিত হয়ে থাকে। বার্মার মানুষ মঙ্গলীয় মানবধারাভুক্ত। মঙ্গলীয় মানবধারার বৈশিষ্ট্য হলো এদের মাথার চুল ঋজু ও খড়খড়ে। অর্থাৎ মাটিতে পড়লে বিশেষ বাঁকে না। এদের চোখের ওপর পাতায় থাকে বিশেষ ধরনের ভাঁজ। যে কারণে এদের চোখ দেখলে মনে হয় ছোট এবং বাঁকা। এদের গন্ডের হাড় হয় উঁচু। যে কারণে এদের মুখমণ্ডল দেখে মনে হয় সমতল। এদের মুখে দাড়ি-গোঁফ হয় না বললেই চলে। মঙ্গলীয় মানবধারার মানুষের কারো মাথা গোল আবার কারো হয় মধ্যম আকৃতির।
বর্মি ও আরাকানিদের মধ্যে এই সব মঙ্গলীয় মানব ধারার বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবেই বিদ্যমান। বর্মি ও আরাকানিদের মাথার আকৃতি হলো খুবই গোল এবং মঙ্গলীয় মানবধারাভুক্ত অন্যান্য মানুষের চেয়ে এদের গন্ডের হাড় অপেক্ষাকৃত হলো বেশি উঁচু। আরাকানের সব মানুষ মঙ্গলীয় মানবধারাভুক্ত নয়। যাদের বলা হয় রোহিঙ্গা তারা দেখতে অধিকাংশ বাংলাদেশের মানুষের মতো। এদের মুখে দাড়ি-গোঁফের পরিমাণ হয় যথেষ্ট। মাথার আকৃতি গোল নয়। মধ্যম আকৃতির। ধর্মের দিক থেকে যাদের বলা হয় রাখাইন তারা হলেন বর্মিদের মতোই থেরেবাদি বৌদ্ধ।
কিন্তু রোহিঙ্গারা সবই হলেন মুসলমান। আরাকানের রাজধানী হলো আকিয়াব। এখন যার নাম রাখা হয়েছে শিতুই। আকিয়াব শহরের কাছে একটি প্রাচীন মসজিদ আছে। যার স্থাপত্যরীতি হলো গৌড়ীয়, যা থেকে প্রমাণ হয় আরাকানের একসময় গৌড়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিল। চট্টগ্রাম শহরে আছে পীর বদরের দরগা। যাকে চট্টগ্রামের মুসলমান এবং হিন্দুরা পবিত্র স্থান বলে মনে করেন। আরাকানেও আকিয়াবের কাছে আছে পীর বদরের দরগা। যাকে রোহিঙ্গা এবং আরাকানি বৌদ্ধরা একইভাবে মনে করেন পবিত্র স্থান হিসেবে। বাবা বদর কে ছিলেন এবং কোথা থেকে এসেছিলেন সে সম্বন্ধে স্পষ্টভাবে কিছু জানা যায়নি। তবে বদর নামটি আরবি ভাষার। বদর শব্দের মানে হচ্ছে পূর্ণিমার চাঁদ। বর্মার মূল ভূখণ্ডে অর্থাৎ ইরাবতি নদীর উপত্যকায় যেসব থেরাবাদি বৌদ্ধরা থাকেন তারা গো-মাংস ভক্ষণ করেন না। কিন্তু আরাকানি বৌদ্ধরা গো-মাংস ভক্ষণ করেন এবং তার রন্ধন প্রাণালী রোহিঙ্গাদের মতো।
রোহিঙ্গাদের উদ্ভব
অতীতে ইরাবতি নদীর উপত্যকায় দু’টি রাজ্য ছিল। দক্ষিণের রাজ্যের একজন রাজা ১৪০৪ খ্রিষ্টাব্দে তখনকার আরাকান রাজ্য জয় করেন। আরাকান রাজ্যের রাজা ছিলেন মেং সোয়া-ম্উন। তিনি বর্মি রাজার কাছে পরাজিত হয়ে পালিয়ে আসেন গৌড়ে। এ সময় গৌড়ের সুলতান ছিলেন জালাল উদ্দিন মুহম্মদ শাহ্। তিনি সেনাপতি ওয়ালি খানের নেতৃত্বে ২০ হাজার সৈন্য প্রদান করেন আরাকান রাজাকে তার হৃতরাজ্য যুদ্ধ করে পুনরুদ্ধার করার জন্য। ওয়ালি খান যুদ্ধে জিতেন। কিন্তু তিনি মেং সোয়া ম্উনকে রাজা না করে নিজেই রাজা হয়ে বসেন। বন্দী করেন আরাকানের রাজাকে। কিন্তু মেং সোয়া ম্উন আবার কৌশলে পালিয়ে যেতে পারেন গৌড়ে। গৌড়ের সুলতান এবার তাকে সিদ্ধি খান নামে আরেকজন সেনাপতির অধীনে ৩০ হাজার সৈন্য দেন আরাকান উদ্ধারের জন্য। সিদ্ধি খান ওয়ালি খানকে যুদ্ধে হারান ও মেং সোয়া ম্উনকে আরাকানের রাজা করেন। সেনাপতি ওয়ালি খানের সৈন্যরা যোগ দেন সিদ্ধি খানের সৈন্যদের সঙ্গে। ওয়ালি খান পালিয়ে যান। এইসব গৌড় থেকে যাওয়া মুসলমান সৈন্যরা থেকে যান আরাকানে। মেং সোয়া ম্উন আরাকানের নতুন রাজধানী করেন। যার নাম দেন ম্রোহং অথবা রোহং।
রোহং শহরে বাস করতে থাকেন গৌড় থেকে যাওয়া মুসলমান সৈন্যরা। এদের বংশধরকে বলা হতে থাকে রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গারা আরাকানে বহু দিন আগে থেকেই আছেন। হঠাৎ বাংলাদেশ থেকে তারা যাননি। তারা যখন আরাকানে যান তখন আরাকান বর্মার অংশ ছিল না। আরাকানের অনেক রাজা সে দেশে চট্টগ্রাম থেকে অনেক মুসলমানকে নিয়ে যান; আরাকানে চাষাবাদ করার জন্য। এরাও ক্রমে পরিচিতি পান রোহিঙ্গা হিসেবে।
আরাকানের ইতিহাসে অনেক রাজার থাকতে দেখা যায় দু’টি করে নাম। যার একটি নাম হলো আরাকানি আর অপরটি হলো গৌড়ের সুলতানদের অনুকরণে। যাকে বলা হয় মুসলমানি নাম। যেমন- মেং সোয়া ম্উন, নাম নেন সবুন খান। মিন খামাউংগা মুসলমানি নাম নেন হোসেন শাহ্। আরাকানি ১৪ জন রাজার এ রকম দু’টি করে নাম পাওয়া যায়। এদের মুদ্রিত মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। যা সংরক্ষিত আছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। এসব মুদ্রা গৌড়ের মুদ্রিত মুদ্রার অনুরূপ। কেবল তাই নয়, এসব অনেক মুদ্রার এক পৃষ্ঠে আরবি কুফিক হরফে লেখা থাকতে দেখা যায় কালিমায়ে তৈয়েবা। অনেকে তাই মনে করেন এসব রাজা আসলে মুসলমান।
বাদশাহ শাহজাহানের পুত্র শাহ্ সুজা ছিলেন বাংলার সুবেদার। তার রাজধানী ছিল রাজমহল, যা এখন পড়েছে ভারতের ঝাড়খণ্ড প্রদেশে। সুজা তার ভাই আরোঙ্গজেবের সেনাপতি মির জুমলার হাতে পরাজিত হয়ে পালিয়ে আসেন ঢাকায়। পরে আবার ঢাকা থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন আরাকানে। সেখানে তিনি দুই বছর থাকেন। কিন্তু বিবাদ বাধে আরাকান রাজার সাথে। আরাকান রাজা সুজাকে সপরিবারে হত্যা করেন। কিন্তু সুজার সৈন্যসামন্ত ও লোকজন থেকে যায় আরাকানে। এরাও হতে থাকে রোহিঙ্গা পদবাচ্য।
আরাকানি জলদস্যু
বাংলায় একসময় আরাকানিদের ‘মগ’ বলা হতো। ‘মগ’ শব্দটির উৎপত্তি পাওয়া যায় না। প্রশ্ন উঠেছে, ‘মগ’ বলতে আসলে ঠিক কাদের বোঝাত? সব আরাকানিকেই কি বলা হতো ‘মগ’ না আরাকানে উপনিবিষ্ট কোনো বিশেষ জাতিকে ‘মগ’ বলা হতো, যারা পর্তুগিজ জলদস্যুদের সংস্পর্শে এসে পরিণত হয় ভয়াবহ জলদস্যুতে। অনেকের মতে, ‘মগ’ নামটা এসেছে বিহারের ‘মগধ’ থেকে যাওয়া লোকদের নাম থেকে। ‘মগধ’ বলতে বোঝাত বর্তমান বিহারের পাটনা ও গয়া জেলার মিলিত ভূভাগকে। এখানকার অধিবাসীরা বৌদ্ধা ছিলেন। চট্টগ্রাম অঞ্চলে কিছু লোক আছেন যাদের বলা হয় ‘মগ’। কিন্তু এরা আরাকানিদের মতো মঙ্গলীয় মানবধারাভুক্ত নন। ‘মগ’ এবং পর্তুগিজরা সাধারণত একত্র হয়েই দস্যুবৃত্তি করত। পর্তুগিজরা যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করত তা ছিল যথেষ্ট উন্নতমানের। তা ছাড়া তারা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে ছিল বিশেষ দক্ষ। মগরা পর্তুগিজদের কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার শিখে তারাও হয়ে ওঠে এ ক্ষেত্রে খুব দক্ষ। পর্তুগিজদের সাধারণ বাংলায় বলা হয় ফিলিঙ্গি। মগ ও ফিলিঙ্গি জলদস্যুদের সম্পর্কে বংশীদাশ খ্র্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে তার রচিত ‘মনসা মঙ্গল’ কাব্যগ্রন্থে বলেছেন-
মগ ফিলিঙ্গি যত
বন্ধুক পালিতা হাত
এক বারে দশ গুলি ছোটে।।
মগরা আসত আরাকান ও চট্টগ্রাম থেকে। চট্টগ্রাম এ সময় ছিল আরাকান রাজার অধীনে। পর্তুগিজরা চট্টগ্রামে গড়ে তোলে বিরাট সমুদ্রবন্দর। যাকে তারা বলত পোর্ত গ্রন্দো। আরাকানের রাজধানী রোহং হয়ে উঠেছিল দাস ব্যবসার বিশেষ কেন্দ্র। আরাকান ও চট্টগ্রামে থেকে মগ পর্তুগিজ জলদস্যুরা এসে পূর্ব ও দক্ষিণবঙ্গ থেকে বহু লোককে ধরে নিয়ে বিদেশের বাজারে দাস হিসেবে বিক্রি করত। বন্দীদের হাতের তালু ছিদ্র করে তার মধ্যে দিয়ে বেত চালিয়ে একজনের সঙ্গে আরেকজনকে বাঁধত। যাতে তারা পালাতে না পারে। পরে তাদের নৌকার পাটাতনের নিচে ফেলে রাখত। প্রতিদিন খাওয়ার জন্য কিছু চাল ফেলে দিত। বাদশাহ আরোঙ্গজেব তার ভাই সুজাকে নিজেই মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আরাকানের রাজা সুজাকে হত্যা করার জন্য তিনি খুবই ক্ষুব্ধ হন এবং মনে করেন এটা মোগল সম্রাটের জন্য অবমাননাকর। তিনি বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খানকে চট্টগ্রাম অধিকার করতে বলেন। শায়েস্তা খানের সঙ্গে যুদ্ধে আরাকানের বিরাট নৌবহর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। মগ দস্যুদের অত্যাচার বন্ধ হয়ে যায়। শায়েস্তা খান নাফ নদীর ওপারে আরাকানের কিছু জায়গা দখল করে নিতে সক্ষম হন। চট্টগ্রামের নাম বদলে তিনি রাখেন ইসলামাবাদ।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের ইতিহাস অনুশীলন করলে দেখা যায় অতীতে কখনো তা থেকেছে বাংলার সুলতানদের হাতে কখনো বা থেকেছে আরাকানি রাজাদের হাতে। মোগল আমলে তা আরাকানি রাজাদের নিয়ন্ত্রণ থেকে আসে বাদশাহী শাসনের হাতে। এই অঞ্চলের সীমানা নির্ধারিত হয়েছে সুবেদার শায়েস্তা খানের সময়। পাকিস্তান আমলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তান ও আরাকানের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে যে জটিলতা ছিল তা নিরসন করেন। নাফ নদীকে সীমানা মেনে নিয়ে নাফ নদীর ওপারে ৫ মাইল চওড়া জায়গা তিনি ছেড়ে দেন আরাকানকে। এভাবে পূর্ব পাকিস্তান ও আরাকানের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি হতে পারে। পাকিস্তান আমলে কোনো রোহিঙ্গা সমস্যা উদ্ভব হয়নি। কেননা সামরিক শক্তিতে সাবেক পাকিস্তান ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী। বার্মার সরকার পাকিস্তান সরকারকে ভয় করে চলত।
আজ রোহিঙ্গা সমস্যা দেখা দিয়েছে তার একটি কারণ হচ্ছে আমাদের সামরিক দুর্বলতা। আজ বার্মার সৈন্যরা স্পিড বোটে করে এসে বাংলাদেশের পানি সীমানায় বাংলাদেশের মাছ ধরার ট্রলারের ওপর গুলি ছুড়ছে। আমাদের মাছ ধরার জেলেরা হচ্ছে আহত, যা অতীতে কখনো হয়নি। কেবল রোহিঙ্গাদের ওপরই যে অত্যাচার হতে পারছে তা নয়। বাংলাদেশের পানি সীমানার মধ্যে বাংলাদেশের জেলেরা পাচ্ছে না মৎস্য শিকার করতে।
আমাদের কোনো এক পত্রিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো এক খ্যাতনামা অধ্যাপক লিখেছেন যে আরাকানে যা হচ্ছে তার মূলে আছে মুসলিম মৌলবাদ। কিন্তু মুসলিম মৌলবাদ যদি আরাকানে থেকেই থাকে তাহলেও কি রোহিঙ্গাদের গণহারে হত্যার সমর্থন করা চলে? সব রোহিঙ্গা নিশ্চয় মুসলিম মৌলবাদী নন। কিন্তু গণহত্যা চালানো হচ্ছে নির্বিচারে। অন্য দিকে বাংলাদেশের মৎস্য শিকারিদের ওপরও বার্মার ফৌজ গুলি চালাতে কুণ্ঠিত হচ্ছে না। জেলেরা নিশ্চয় মুসলিম মৌলবাদী নন। তারা মাছ ধরা জেলে মাত্র। যার সঙ্গে মুসলিম মৌলবাদের কোনো যোগাযোগ নেই। পবিত্র আল কুরআনে অবশ্য বলা হয়েছে, সমুদ্রে মাছ ধরতে। এটা করলে মানুষকে খাদ্যাভাবে কষ্ট পেতে হবে না। এটা হলো আল কুরআনের নির্দেশ (সূরা-৫, আয়াত-৯৯)। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্দিষ্ট হয়েছে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের দ্বারা। কিন্তু আন্তর্জাতিক আদালতের কোনো ফৌজ নেই। যার দ্বারা এই রায় বাস্তবে বলবৎ হতে পারে। আন্তর্জাতিক আদালতের রায় বলবৎ করতে হবে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকেই।
বাংলাদেশ বার্মার চেয়ে নিশ্চয় সমর শক্তিতে নিম্নমানের নয়। কিন্তু আমাদের অনেক খ্যাতনামা বাম বুদ্ধিজীবী আকারে-প্রকারে বোঝাতে চাচ্ছেন, এ রকম কিছু করা উচিত হবে না। কেননা এর ফলে তাদের মতে বাংলাদেশে মুসলিম মৌলবাদ নাকি প্রাবাল্য পাবে। এদের যুক্তি বোঝা হয়ে উঠেছে দারুণ কঠিন। এরা বলছেন, রোহিঙ্গা নেতারা নাকি চাচ্ছেন আরাকানের সমস্যাকে ইসলাম বনাম থেরাবাদী বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্ঘাত করে তুলতে। কিন্তু এরা কি জানে না যে, বার্মা একটি ধর্মনিরপেক্ষা রাষ্ট্র নয়। এর রাষ্ট্রধর্ম হচ্ছে থেরাবাদী বৌদ্ধ। আর গোটা বার্মার রাজনীতিতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা পালন করছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সেনাবাহিনীর পরেই রাজনীতিতে হলো তাদের স্থান। বার্মার রাজনীতি মোটেও ধর্মনিরপেক্ষা নয়।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য বলে মনে করি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আরাকানের বৌদ্ধরা নিয়েছিলেন জাপানের পক্ষ। অন্য দিকে আরাকানের মুসলমানরা নিয়েছিলেন ব্রিটেনের পক্ষ। ব্রিটেন এ সময় মৌখিকভাবে অঙ্গীকার করেছিল যে, সে যুদ্ধে জিতলে উত্তর আরাকানকে একটা পৃথক প্রদেশ করবে। উত্তর আরাকান মুসলিমপ্রধান। কেবল তাই নয়, সমগ্র উত্তর আরাকানের অধিকাংশ লোক দেখতে বাংলাদেশের অধিবাসীর মতো। উত্তর আরাকানে হাটবাজারে চলত চট্টগ্রামের বাংলাভাষা, আরাকানি ভাষা নয়। উত্তর আরাকানকে তাই মনে করা চলে বাংলাদেশেরই অংশ।
প্রকাশিত দৈনিক নয়া দিগন্তে, ০৭ জানুয়ারি ২০১৭।