কবিতার স্বরূপ নিয়ে আলোচনা হয়েছে অনেক, আর আলোচনা হবে আরো অনেক। কি হলে ভাল কবিতা হয়, আর কি না হলে ভাল কবিতা হয় না, এ-নিয়ে চিন্তার ছেদ ঘটা সহজ নয়।
কবিদের সাধারণত মনে করা হয় স্রষ্টা। তাঁরা সৃষ্টি করেন। সৃষ্টি যে বোঝেন, এমন নয়। এখানে সমালোচক আর সাহিত্যের অধ্যাপকরা এসে ভিড় জমান। দাবী করেন, সুন্দর ও কবিতার স্বরূপ সম্পর্কে মন্তব্যের একক এজেন্সি। কবিকে ছাড়িয়ে কাব্যভাষ্যের অধিকার।
যতদূর মনে পড়ছে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় একটা উপমা দিয়েছেন। বলেছেন, গাছ আলোর দিকে বেঁকে যায়। এই বেঁকে যাওয়াটা তার ধর্ম। বিজ্ঞানী খুঁজে বের করেন, এই বেঁকে যাওয়ার কারণ। বিশ্লেষণ করেন ঘটনাটিকে। কবির কবিতা লেখেন। লেখাটা তাদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। কবিতার ব্যাখ্যা করা তাদের প্রচেষ্টার অবিচ্ছেদ অঙ্গ নয়।
কিন্তু খতিয়ান নিলে দেখা যায়, কথাটা রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তো নয়-ই, অন্যান্য আরো বহু কবির ক্ষেত্রেই খাটে না। কবিরা যুগে যুগে কেবল কবিতা লিখেই ক্ষান্ত হন নি, মাথা ঘামিয়েছেন কবিতার স্বরূপ নিয়ে, তাদের নিজেদের লেখা নিয়ে আর সব শিল্পের গোড়ার কথা যে সুন্দর, তার সত্তা নিয়ে। কবি বোদেল্যার (ইধঁফবষধরৎব)-এর ব্যতিক্রম নন।
বোদেল্যার শিল্প-দর্শনের গোড়ার কথা দু’টি : সৌন্দর্য চিরকালই অচেনা। পূর্বাহ্নে কেউ বলে দিতে পারে না, কি হলে কবিতা হবে সুন্দর। সুন্দর কবিতা – ধরাবাঁধা ছক হতে পারে না। বোদেল্যার-এর কথায়, ‘ল্য বোব এ তুজুর বিজার’। বোদেল্যার-এর দ্বিতীয় বক্তব্য হল, সার্থক কবিতার জন্ম হয় তখনই, কবি যখন কবিতা রচনা করেন কবিতা রচনার বিশেষ আনন্দে। কবিতা রচনাই যখন হয় কবির কবিতা লেখার মূল প্রেরণা। বোদেল্যার-এর মতে, কবিতাই কবিতার উদ্দেশ্য, অন্য কিছু নয়। তাঁর নিজের কথায়, ‘লা পয়েজি না পা দো’তর বুত কে’ল-মেম| আমরা নীচে শিল্প প্রসঙ্গে বোদেল্যার-এর বিভিন্ন রচনা থেকে কিছু কিছু অংশ অনুবাদ করে দিচ্ছি। উদ্দেশ্য, বোদেল্যার-এর নিজের জবানিতেই তাঁর শিল্প-দর্শনকে পাঠকের কাছে তুলে ধরা।
বোদেল্যার এসব কথা বলেছেন আজ থেকে একশো বছরের আগে। কিন্তু এই একশো বছরের মধ্যে মনে হয়, মানুষের নন্দন-তত্ত্বের (অবংঃযবঃরপ) সমস্যা সেই একই রকম থেকে গিয়েছে। “অনিয়ম মানে অভাবনীয়তা, আশ্চর্য ও বিস্ময় এদের দিয়েই গঠিত সৌন্দর্যের একটি অপরিহার্য অঙ্গ আর এদের কেন্দ্র করেই জন্ম নেয় সুন্দর।”
“একথা সকলেরই জানা, যদি কেউ সুন্দরকে সত্যি অনুভব করতে চায়, তবে তা মাননীয় বিচারক অধ্যাপক মণ্ডলীর মানদণ্ড দিয়ে সম্ভব নয়। কারণ, সৌন্দর্যের সত্তা কোন ধরাবাঁধা ছকে পড়ে না। যদি পূর্বাহ্ণেই বলে দেওয়া যায়, এই এই গুণ, ঠিক এই পরিমাণে থাকলে, কোন কিছু হবে সুন্দর, তবে সেই নিয়মের নিগড়ে পড়ে সৌন্দর্যের হবে মৃত্যু। কারণ, একই নিয়মের পৌনঃপুনিকতায় সৃষ্টি হবে এক বৈচিত্রহীন একঘেয়েমি। তার মধ্যে থাকবে না শিল্পীর ব্যক্তিত্বের ছোঁয়া। সব কল্পনা, সব সংবেদন পাবে এক ব্যক্তি বিহীন ঐক্য। যা আমাদের অনুভূতিকে ক্লান্ত আর বিরূপ করে তুলতে বাধ্য। সত্যিকার শিল্পকর্মের সার্থকতা, তার মধ্যে নতুন কিছুর আবির্ভাব দিয়ে। ধরাবাঁধা নিয়মের ব্যাতিক্রম সেখানে ঘটতে বাধ্য। শিল্প কর্মকে কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের রচিত নিয়ম ও বিশ্লেষণের ছকে আটকে দেওয়া যায় না।”
“সৌন্দর্য সব সময়য়েই অদ্ভুত। আমি অবশ্য বলতে চাই না সৌন্দর্যের সত্তা এমনিতেই অদ্ভুত। কারণ, সে-ক্ষেত্রে তা হবে জীবনের সহজ পথ-ধারা থেকে বিচ্যুত কদাকার দানব। আমি অদ্ভুত বলতে বোঝাতে চাই না, এমনি ধরনের কোন কিছুর অস্তিত্ব। আমার কাছে, সুন্দরের আবির্ভাব এক অভাবনীয় আবির্ভাব। তা সব সময়েই এই অর্থে অদ্ভুত। যাকে বলা চলে এক সরল অকপট তদ্ভুত-যাকে ঠিক আগে থেকে অনুমান করা চলেনি, অথচ সৃষ্টির পথ ধরে আপনা থেকে আপনি হয়েছে উদ্ভুত। এই আগে থেকে অচেনাঅজানা অদ্ভুতের আবির্ভাবকে কেন্দ্র করেই সমুদিত হয়, জেগে ওঠে শিল্পের সৌন্দর্য।”
“একদল লোক বলে থাকেন, কবিতার লক্ষ্য কোন না কোন ভাবে মানুষকে কিছু জ্ঞান বিতরণ করা। মানুষের মধ্যে কোন না কোন বিশেষ চেতনাকে সঞ্চারিত করা। মানুষের মধ্যে সুনীতির উদ্বোধন ঘটান। এই ভাবেই কবিতা মানুষের কাজে লাগে, প্রয়োগ মূল্য পায়।…কিন্তু কবি যখন তার কবিতার উৎস সন্ধানে লিপ্ত হয়, তখন শেষ অবধি এক কবিতা লেখার ঐকান্তিক ইচ্ছাকে ছাড়া আর কোন কিছুর অনুসন্ধান পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়না। কবিতার আর কোন লক্ষ্য নেই। কবিতাই কবিতার লক্ষ্য।…কোন কবিতাই শেষ পর্যন্ত রসোত্তীর্ণ হতে পারে না, যদি না কবিতা রচনা করেন সৃষ্টির আনন্দে। যে সব কবিতা আমরা সত্যিকারের কবিতা বলে আখ্যা দিয়ে থাকি, তাদের সবার সৃজন রহস্য লুকিয়ে আছে এইখানেই। সব মহৎ কবিতার সৃষ্টি হয়েছে এক কবিতা সৃষ্টির স্বতন্ত্র আনন্দে।
আমি এ কথা বলিনা, কবিতা মানুষকে কোন নৈতিক অনুপ্রেরণা জোগাতে পারেনা বা মানুষকে কোন মহৎ ভাব বা আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত করতে পারেনা। যদি আমায় কেউ ঠিকমত বুঝতে চেয়ে থাকেন, তবে আমার বক্তব্য : কেবল কোন নীতিকথা প্রসারের উদ্দেশ্য নিয়েই যদি কেউ কবিতা লেখায় হাত দেন, তবে সেক্ষেত্রে কবিতা হারাতে বাধ্য তার অন্তর্লীন শক্তি। আর অসংগত নয়-সে কবিতা স্বাভাবিক ভাবেই হয়ে উঠবে নীচু পর্যায়ের সৃষ্টি।…কোন বিশেষ সত্যকে প্রমাণ করে দেখান অন্য কিছুর কাজ-কবিতার এলাকায় তা আসে না।”
“অনেক কথাই শোনা যায়, সাহিত্য নিয়ে বিতণ্ডামুখর চক্রে-বিরাট আর ভয়াবহ : শিল্প, সৌন্দর্য, নীতি, উপযোগ। এঁরা সব কিছুকেই মিশিয়ে ফেলেন একত্রে। এঁদের মধ্যে দেখা যায় দার্শনিক প্রাজ্ঞতার অভাব। সত্যের পতাকার একটি বিশেষ টুকরো অংশকে উঁচিয়েই এঁরা তারস্বরে ঘােষণা করতে ব্যস্ত, অন্যপক্ষ সর্বতোভাবে মিথ্যা। ভাবতে দুঃখ হয় মনে, আমরা আজ দু’টি পরস্পর বিরোধী সম্প্রদায়ের সংঘাতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছি। একাধারে বুর্জোয়া গোষ্ঠী। অন্যদিকে হল সমাজতান্ত্রিক দল। নীতি কথা শোনাও! নীতি কথা শোনাও! এই হল মিশনারী হুজুগে মাতা এই দুই পক্ষের বুলি। স্বাভাকিক (স্বাভাবিক)ভাবেই একদলের পুজি হল সনাতন বুর্জোয়া নৈতিকতা, আর অন্যদিকের পুঁজি হল সমাজতান্ত্রিক। কিন্তু এঁদের উভয়ের কাছেই শিল্পকর্ম হল কেবল প্রোপাগাণ্ডার হাতিয়ার।”
উপরের আলোচনা থেকে কবি সম্পর্কে একটা ভুল ধারণার সৃষ্টি হতে পারে। মনে হতে পারে, বোদেল্যার বলতে চান, কলমের ডগায় সহজ ভাবে যা আসে, তাই শিল্পমূল্য সম্পন্ন। বোদেল্যার-এর কবিতার পাণ্ডুলিপির ফটো দেখলে এই ভুল ধারণা ভাঙ্গে। তিনি তাঁর প্রতিটি কবিতা রচনার পর, তা’ কাটাছাটা করেছেন বহুবার, এমনকি ছাপাতে দেবার পরেও ঘটিয়েছেন তাদের মূল দেহে পরিবর্তন। অনেক কাব্য ঐতিহাসিক মনে করেন, বোদেল্যার-এর কবিত্যার (কবিতার) সংখ্যা স্বল্প হবার এ অন্যতম প্রধান কারণ। অপরিসীম শ্রম ও সময় ব্যয় করতেন তিনি তাঁর প্রতিটি কবিতার পেছনে। ফলে সময়ই জোটেনি তাঁর বহু সংখ্যক কবিতা লেখার।
সিকানদার আবু জাফর (সম্পাদিত) ; সমকাল, অষ্টম বর্ষ, কবিতা সংখ্যা, পৌষ-চৈত্র-১৩৭১।