মানুষের ব্যক্তিগত পরিবেশ তার চিন্তা-চেতনাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। আমি একজন সাধারণ মানুষ। আমার মনে হয়, আমি আমার পরিবেশ দ্বারা খুব বেশি প্রভাবিত হয়েছি। ইংরেজরা যখন এই উপমহাদেশ ছেড়ে যায়, অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে তখন আমার বয়স ছিল ১৭ বছর। যে পরিবারে আমার জন্ম, সে পরিবারে পড়েছিল ব্রিটিশ চিন্তা-চেতনার প্রভাব। আর আমি হয়েছিলাম তার দ্বারা প্রভাবিত।
ব্রিটেনের ইতিহাস কিছুটা পড়েছিলাম স্কুলে। কিছুটা পড়েছিলাম বাড়িতে। আমি ব্রিটিশ গণতন্ত্রের ওপর শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, সাবেক পাকিস্তানে ব্রিটিশ গণতন্ত্রের ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা পেতে পারবে। কিন্তু সেটা হয়নি। ১৯৭১ সালে ভেবেছিলাম বাংলাদেশ অনুসরণ করবে ব্রিটিশ গণতন্ত্রের পথ। কিন্তু এখনো চলেছে সংবিধান নিয়ে বিতর্ক। আমরা কী রকম রাষ্ট্র চাই সেটা এখনো স্বচ্ছ নয় আমাদের কাছে।
ব্রিটেনের সংবিধান নিয়ে মাথা ঘামাইনি। ব্রিটেনের এখনো নেই কোনো লিখিত সংবিধান। ব্রিটেনে কেবল আছে সংবিধানের স্খলে কিছু মৌলিক বিধান। যেগুলোকে মেনেই চলেছে ব্রিটিশ গণতন্ত্র। আসলে গণতন্ত্র নির্ভর করে একটা দেশের মানুষের মনমানসিকতার ওপর। কেবলই সংবিধানের ওপর নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের কবি আলেকজান্ডার পো লেখেন
For forms of government let fools contest;
What’re is best administered is best.
ইংল্যান্ডের কবি সরকারের আইনগত কাঠামোর চেয়ে সুশাসিত সরকারের ওপর অধিক গুরুত্ব দিতে বলেছেন। সুশাসন কেবল সরকারের কাঠামোর (Form) ওপর যে নির্ভর করে তা নয়। তা নির্ভর করে একটা দেশের মানুষের সাধারণ মনমানসিকতার ওপর। ব্রিটেনে গণতন্ত্র সাফল্য লাভ করতে পেরেছে মানুষ সে দেশে মনোভাবের দিক থেকে গণতন্ত্রী হতে পেরেছে বলে। ব্রিটিশ চিন্তায় জঙ্গি মনোভাব (Radicalism) প্রশ্রয় পেতে পারেনি।
এ কথা ঠিক যে, বিলেতে ইউরোপের মধ্যে রাজার বিরুদ্ধে প্রজার বিদ্রোহ ঘটেছে প্রথম। যার ফলে প্রজার হাতে কাটা পড়েছে রাজার মাথা। কিন্তু ব্রিটেনের ঘরোয়া রাজনীতিতে রক্তপাত প্রাধান্য পেতে পারেনি। মানুষ সে দেশে অনুসরণ করতে চেয়েছে আপস-রফা ও খাপ খাইয়ে চলার পথ। রাজনীতিতে বিপ্লবের পথ গ্রহণ না করে বিলেতে মানুষ চেয়েছে ক্রমবিবর্তনের পথ গ্রহণ করতে। ব্রিটিশ গণতন্ত্রের মূল কারণ নিহিত আছে সে দেশের মানুষের এই মনোভাবের মধ্যে।
আমরা দীর্ঘদিন বিলেতের নিয়ন্ত্রণে ছিলাম। কিন্তু তার এই মনোভাব আমাদের মধ্যে দৃঢ়মূল হতে পারেনি। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে ব্রিটিশ গণতন্ত্রের ধারণা অনেক গভীর প্রভাব ফেলতে পেরেছে। আর ভারতে তাই প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্রে হয়তো অসঙ্গতি আছে অনেক, কিন্তু তা সত্ত্বেও একে দিতে হয় সাধুবাদ। ভারত চলেছে উদার গণতান্ত্রিক ধারা অনুসরণ করে। যেটা আমরা এখনো অনুসরণ করতে পারছি না এবং চাচ্ছি না সেভাবে।
আমরা সংবিধান নিয়ে অযথা বিতর্ক তুলছি। যেটা না তুললেও চলে। ব্রিটেনের কোনো লিখিত সংবিধান নেই। আছে কতগুলো মৌলিক বিধান। যেগুলো লঙ্ঘিত হয় না বলেই ব্রিটেনে চলতে পারে গণতান্ত্রিক সরকার। এ ক্ষেত্রে আমরা যদি ব্রিটেনকে অনুসরণ করি তবে আমাদের দেশেও পেতে পারবে গণতন্ত্র তার প্রতিষ্ঠা। মানুষকে নিয়েই রাষ্ট্র। মানুষের মন গণতান্ত্রিক না হলে রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হতে পারে না। আমাদের এই সত্যকে উপলব্ধি করতে হবে।
গণতন্ত্রের একটি মূল কথা, পরমতসহিষ্ণুতা। আমাদের মধ্যে যার অভাব খুবই পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন অপরিহার্য; যদি আমরা দেশে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাই। ধর্মের প্রভাব এক সময় গ্রেট ব্রিটেনের রাজনীতিতে যথেষ্ট ছিল। কিন্তু আজ আর তা আগের মতো নেই। ইংল্যান্ডে রোমান ক্যাথলিকরা পার্লামেন্টে ১৮৩০ সালের আগে পর্যন্ত সদস্য হতে পারতেন না। ইহুদিরা পারত না ১৮৫৮ সালের আগ পর্যন্ত। ইংল্যান্ডে নাস্তিকরা পার্লামেন্টে সদস্য হওয়ার অধিকার পায় ১৮৮৬ সালে। ব্রিটেনের রাজনীতিতে কমে এসেছে ধর্মের প্রভাব।
ব্রিটেন এখন ঠিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয়। ব্রিটেনের রাজা ও রানীকে হতে হয় অ্যাংলিক্যান (Anglican)। কিন্তু ব্রিটেনের রাজনীতিতে রাজা বা রানী এখন ক্ষমতায় আছেন নামে মাত্র। তাদের ক্ষমতা এখন আর রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রিত করে না। যেমন করেছে অতীতে। ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে আছে রাজা বা রানী সে দেশের রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকার কারণেই। ব্রিটেন হলো পুরোপুরি সংসদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রাজতন্ত্র। আমরা বলেছি, গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি হলো পরমতসহিষ্ণুতা। আমাদের দেশে গণতন্ত্র পূর্ণতা পেতে হলে পরমতসহিষ্ণুতা হতে হবে এর ভিত্তি। আর ধর্মীয় গোঁরামিকে আসতে হবে কমে।
মানুষ এক সময় মনে করেছে, রাষ্ট্র হলো ঈশ্বর সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান। এক সময় রাজারা বোঝাতে চেয়েছেন, তারা হলেন মর্ত্যে ঈশ্বরের প্রতিনিধি। আর তাই তাদের মেনে চলতে হবে প্রজাদের। প্রাচীন ব্যাবিলনের সম্রাট হামুরাবির (Hammurabi) আইনের অনুশাসন খুব বিখ্যাত। কালো পাথরের গায়ে খোদিত তার এই আইনের অনুশাসনের উপরিভাগে রয়েছে তার নত-উন্নত মূর্তি। যাতে দেখানো হয়েছে সম্রাট তার এই আইনের বিধান গ্রহণ করছেন সূর্য দেবতা শামস্-এর কাছ থেকে। হামুরাবির রাজত্বকাল ধরা হয় আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২০০১ সালের কাছাকাছি।
কিন্তু এখন আমরা মনে করি রাষ্ট্র মানুষের সৃষ্টি। আর তাই জনগণের দ্বারা প্রণীত আইন দ্বারা পরিচালিত হতে হবে রাষ্ট্রকে। এ ক্ষেত্রে ঐশ্বরিক বিধান বলে কিছু থাকা সম্ভব নয়। একটা দেশের এমন সব নিয়মের সমষ্টি, যেগুলো প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের ভেতরে সার্বভৌম শক্তির বন্টন অথবা কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এসব নিয়মও হলো দেশবাসীরই সৃষ্টি। বিধাতা প্রদত্ত নয়। অর্থাৎ প্রয়োজনে তারাও পরিবর্তনসাপেক্ষ। তবে আইনের ঘনঘন পরিবর্তন আইনের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে। আর একটা দেশের আইন ব্যবস্খাকে করে তুলতে চায় দুর্বল ও অকার্যকর। এক দলের রাজত্বে গণতন্ত্র টেকে না। গণতন্ত্রে একাধিক রাজনৈতিক দল থাকা অপরিহার্য। অবশ্য দলাদলির একটা সীমা থাকা প্রয়োজন। বেশি দল গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকরও।
বিলেতে গণতন্ত্র সাফল্য লাভ করতে পেরেছে। কারণ, সে দেশে গণতন্ত্র চলেছে প্রধানত দুই দলকে ভিত্তি করে। ব্রিটেনে রাজনৈতিক দলাদলি মাত্রা ছাড়াতে পারেনি। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্খার সমালোচনা করেছেন অনেকেই। বিপ্লব করার নামে হয়েছে একদলীয় রাজত্বের প্রতিষ্ঠা। যার একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রব্যবস্খা। কিন্তু এই রাষ্ট্রব্যবস্খা এখন ভেতর থেকেই ভেঙে পড়েছে। রাশিয়া অনুসরণ করতে যাচ্ছে বহুদলীয় গণতন্ত্রেরই চর্চা।
১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ প্রভাবিত হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বারা। তারা দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল এক দলের রাজত্ব। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কখনোই স্বীকার করেনি যে, একদলীয় শাসনব্যবস্খা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা ছিল একটা ভ্রান্ত পদক্ষেপ। আওয়ামী লীগ সংবিধান পরিবর্তনের কথা বলছে। দেশবাসীর মনে তাই জাগছে নানা জিজ্ঞাসা। আওয়ামী লীগ কি চাচ্ছে দেশে এক দলের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে! আমাদের মনে হয় সংবিধানের ওপর অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি না করে দেশে যাতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায় সে চেষ্টাই বলবৎ রাখা উচিত। তবে এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে, দেশে সংবিধানের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন অবশ্যই আছে। তবে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধান শেষ কথা নয়।
গণতন্ত্রের ভিত্তি মানুষ। মানুষকে গণতন্ত্রী হতে হবে। আইন ও স্বাধীনতার প্রস্তুতি যথেষ্ট পুরনো। আইন স্বাধীনতার পূর্বশর্ত (Law is the condition of liberty)। একটা দেশে বেশির ভাগ মানুষ স্বেচ্ছায় আইন মানে বলে, আইন রক্ষা করা সম্ভব হয়। কেবল শাস্তির মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা যায় না। যদিও তার প্রয়োজনীয়তা আছে। আইনের প্রতিষ্ঠায় শক্তি প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রেই অনিবার্য হয়ে ওঠে। দেশের সংবিধান থাকতে হবে। সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু কেবল সংবিধান দিয়েই আসতে পারবে বাঞ্ছিত গণতন্ত্র এমন আশা বাস্তবভিত্তিক হবে না। গণতন্ত্র নির্ভর করবে আমাদের রাজনৈতিক চেতনার ওপর।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
[সূত্রঃ নয়া দিগন্ত, ০৯/০৫/১১]