সুন্দরবন নিয়ে আগে আমরা লিখেছি; কিন্তু এখন আবার কিছু লিখছি। কেননা, সুন্দরবন নিয়ে পত্রপত্রিকায় এমন অনেক কিছু বলা হচ্ছে, যার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। সুন্দরবনের বয়স বেশি নয়। সুন্দরবন যখন ছিল না, তখনো ছিল বাংলাদেশ। ছিল বাংলাদেশের মানুষ। তাই সুন্দরবন না থাকলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে, এ রকম কথা ইতিহাসের নিরিখে বলা যায় না। যারা সুন্দরবনের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে অবগত নন অথবা অন্য কোনো রাজনৈতিক কারণে করতে চাচ্ছেন জানিত ইতিহাসকে বিকৃত, তারাই পত্রপত্রিকায় প্রচারমুখর হয়ে উঠেছেন, সুন্দরবন না থাকলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে।
সুন্দরবন বলতে যে এলাকাকে বুঝায়, তা উত্তর অক্ষরেখা ২১ ডিগ্রি ৩১ মিনিট এবং ২২ ডিগ্রি ৩৮ মিনিটের মধ্যে এবং পূর্ব দ্রাঘিমা রেখা ৮৮ ডিগ্রি ৫ মিনিট ও ৯০ ডিগ্রি ৮০ মিনিটের মধ্যে অবস্থিত। এর মোট আয়তন ছয় হাজার বর্গ কিলোমিটার, যার মধ্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পড়েছে দুই হাজার ৪০০ বর্গ কিলোমিটার। ভারতের সুন্দরবন নিয়ে তেমন কোনো হইচই নেই, কিন্তু বাংলাদেশে আছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তা হয়ে উঠেছে একটা বিশিষ্ট আলোচ্য বিষয়। সুন্দরবনের বনজসম্পদ নিয়ে কোনো আলোচনা হচ্ছে না। যদিও বা উচিত ছিল হওয়া। সুন্দরবনকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে আমাদের আয় বাড়াতে পারি, তা নিয়ে আমরা ভাবছি না। সাবেক পাকিস্তান আমলে সুন্দরবনের গেওয়া গাছের কাঠ থেকে তৈরি করা হচ্ছিল নিউজপ্রিন্ট; কিন্তু বর্তমানে তা বন্ধ আছে। সুন্দরবনর গেওয়া গাছের ছালে প্রচুর ট্যানিন আছে, যা দিয়ে চামড়া ট্যান করা যেতে পারে; কিন্তু আমরা সেটা করছি না। সুঁদরী গাছের কাঠকে অল্প বাতাসে পোড়ালে খুব ভালো কাঠ-কয়লা পাওয়া যায়। এই কাঠ-কয়লাকে গুঁড়ো করে তা দিয়ে বানানো চলে বারুদ; কিন্তু আমরা বারুদ বানাবার কাজে সম্ভবত সুঁদরী গাছের কাঠ-কয়লা ব্যবহার করতে যাচ্ছি না। আমাদের বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে সুন্দরবনের নরখাদক বাঘ ও নরখাদক কুমির এবং বহুবিধ বিষধর সর্পকে রক্ষা করা; সুন্দরবনকে জাতীয় প্রয়োজনে ব্যবহার করা নয়।
সুন্দরবনকে নাকি ইউনস্কোর পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে আন্তর্জাতিক উত্তরাধিকার হিসেবে; কিন্তু সুন্দরবন হলো বাংলাদেশে অবস্থিত (ভারতের অংশ বাদ দিয়ে)। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। সুন্দরবন তার অংশ। সে সুন্দরবনকে কিভাবে ব্যবহার করবে, সেটা কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা ঠিক করে দিতে পারে না। সেটা ঠিক করবে বাংলাদেশের সার্বভৌম সরকার। ইউনেস্কো অনেক কিছুই করছে যা গ্রহণযোগ্য নয়। সাবেক পাকিস্তান আমলে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে সর্বসাধারণ আন্দোলন করেছিল বাংলা ভাষাকে তদানীন্তন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে। সাবেক পাকিস্তানে বাংলা ভাষা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন একটা ব্যর্থ আন্দোলন ছিল না; কিন্তু এখন ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। যেটা খুবই বিভ্রান্তিকর। কেননা ২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলন মাতৃভাষা আন্দোলন ছিল না। ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। পৃথিবীর কয়টা দেশে মাতৃভাষার দিবস পালিত হয়, আমরা তা জানি না। ইউনেস্কো চাচ্ছে সুন্দরবনে বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ; কিন্তু নরখাদক বাঘ, কুমির ও বিষধর সাপ বাঁচিয়ে রেখে বাংলাদেশের মানুষ কোনোভাবেই উপকৃত হতে পারে না। সুন্দরবনের বনজসম্পদ কাজে লাগাতে হলে মানুষের শত্রু এসব প্রাণীকে অবশ্যই নির্মূল করতে হবে। এর জন্য ইউনেস্কোর কোনো নির্দেশ মেনে চলা সম্ভব নয়।
অনেকের মতে, এখন যেখানে সুন্দরবন, সেখানে অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর জনপদ ছিল। সুন্দরবনের মাটি খুঁড়ে মাঝে মধ্যে ভূগর্ভে শানবাঁধানো পুকুর ও অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া অনেক জায়গায় মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষরাজির কাণ্ড, যা থেকে অনুমিত হয় যে, সুন্দরবনের মাটি কোনো কারণে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে হঠাৎ দেবে গিয়েছিল। ফলে জনপদগুলো হয়েছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত। পরে সেখানে গড়ে উঠেছে বনভূমি। বিখ্যাত ঐহিাসিক নলিনীকান্ত ভট্টশালী এ থেকে সিদ্ধান্ত করেন যে, খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে সব সুন্দরবন এলাকার মাটি ধসে বসে যায়। আর সেই সঙ্গে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ওখানকার সব সমৃদ্ধ জনপদ। অর্থাৎ ভট্টশালীর মত সত্য হলে বলতে হবে, সুন্দরবনের অস্তিত্ব ষোড়শ শতাব্দীর আগে ছিল না।
তাই এখন যারা বলছেন, সুন্দরবন না থাকলে বাংলাদেশ থাকবে না, তাদের কথার ঐতিহাসিক কোনো ভিত্তি আছে বলে মনে করা যায় না। কেননা ষোড়শ শতাব্দীর আগে বাংলাদেশ ও তার মানুষ ছিল। সেটা ইতিহাসের মাপকাঠিতে খুব বেশি দিন আগের ঘটনা নয়। সুন্দরবন জনশূন্য হয়েছিল কেন, তার অন্য রকম ব্যাখ্যাও আছে। মেজর জেমস রেনলের মতে সুন্দরবন জনশূন্য হওয়ার কারণ হলো, মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের অত্যাচার। রেনল প্রথম জরিপ করে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মানচিত্র অঙ্কন করেন (১৭৬৪-৭৬ খ্রি.)। তিনি বলেন, বয়স্ক লোকদের মুখে শুনেছেন, একসময় সুন্দরবন অঞ্চলে সমৃদ্ধ জনবসতি ছিল; কিন্তু মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের অত্যাচারে মানুষ ওই অঞ্চল পরিত্যাগ করে। গড়ে উঠতে থাকে বনভূমি। রেনেলের মত এ কথা তার মানচিত্রে লিখে গেছেন অর্থাৎ রেনেল সত্য হলে বলতে হবে অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে সুন্দরবন ছিল না; কিন্তু আমাদের পরিবেশবাদীরা বলছেন, সুন্দরবন না থাকলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে।
প্রশ্ন হলো, অষ্টাদেশ শতাব্দীর আগে কি বাংলাদেশ ছিল না? কপিল ভট্টাচার্য তার বহুল পঠিত ‘বাংলা দেশের নদ-নদী ও পরিকল্পনা’ নামক বইতে (নভেম্বর, ১৯৫৯) লিখেছেন, ‘সুন্দরবনের কোনো কোনো অংশ ধসে জলে নিমজ্জিত হয়ে গেলেও বাকি অংশে আবার বসবাসের অসুবিধা ছিল না। আর সব অংশ যে একসাথে ধসে জলে নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল, এ কথা মনে করারও কোনো সঙ্গত প্রমাণ নেই। সুতরাং মগ অত্যাচারের রাজনৈতিক কারণেই সুন্দরবনের জনহীনতা ও শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে পরিণত হওয়ার প্রধানতম এবং হয়তো একমাত্র হেতু, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না। রেনেল প্রায় অব্যবহিত পরেই স্থানীয় মানুষের কাছে অনুসন্ধান করেই বলেছেন, মগের অত্যাচারেই সুন্দরবনের অঞ্চল জনহীন। তার অঙ্কিত মানচিত্রে তিনি সুন্দরবন অঞ্চলের ওপর ওই কথাটি লিখে দিয়েছিলেন, ঘটানাটি তার মনে এমনই দাগ কেটেছিল। এ কথাটির গুরুত্ব ভোলা উচিত নয়;’ কিন্তু আমাদের পরিবেশবাদীরা এখন বোঝাতে চাচ্ছেন যে, সুন্দরবন বন হিসেবে বিরাজ করছে বহু প্রাচীনকাল থেকে। সুন্দরবনের সবটাকেই ম্যানগ্রোভ বলা চলে না।
আমরা জানি, প্রতিদিন সমুদ্রে দুইবার করে জোয়ার ও দুইবার করে ভাটা হয়। এই জোয়ার-ভাটা অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় হয় খুবই তীব্র। যাকে সাধারণ বাংলায় বলা হয় তেজ কাটাল। তেজ কাটালের সময় যত দূর লোনাপানি আসে, সেই পর্যন্তই অরণ্যকে বলা যায় ম্যানগ্রোভ। ম্যানগ্রোভে এখনো মানুষ বাস করে না। ম্যানগ্রোভের উত্তরে মিঠাপানির বনের মধ্যে মানুষ গ্রাম গড়ে বাস করতে শুরু করেছে। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৫৫ সালে জমি পত্তনি (হাসিল) দেয়া শুরু হয়। আমাদের পরিবেশবাদীরা সম্ভবত এ ইতিহাস সম্পর্কেও যথেষ্ট পরিজ্ঞাত নন। তাই সুন্দরবন সম্পর্কে করতে পারছেন এমন সব মন্তব্য, যা অনেকের কাছেই মনে হচ্ছে খুবই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
বাংলাদেশেকে যদি ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি করতে হয়, তবে সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে জাহাজ আসা যাওয়ার ব্যবস্থা করতেই হবে। গড়তে হবে একাধিক সমুদ্রবন্দর। তা যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন। বাগেরহাটে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়া নিয়ে অনেক হইচই হচ্ছে; কিন্তু একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়লেই আমাদের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হবে না। সুন্দরবনের ধার ঘেঁষে আরো তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়বার প্রয়োজন হতে পারে। কেননা, সমুদ্রের ধারে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়লে বিদেশ থেকে জাহাজে করে পাথুরে কয়লা অথবা পেট্রোলিয়াম জাতীয় দ্রব্য আমদানি করে তা জ্বালিয়ে ডায়নামো চালাতে খরচ পড়বে কম। তাই বিদ্যুৎ সরবরাহ করাও যাবে অনেক সুলভে। ভারতে অনেক পাহাড়ি নদী আছে; যার স্রোতকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে; কিন্তু আমাদের সেই সুযোগ নেই। সৌর শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব; কিন্তু আমাদের দেশে বছরে বেশির ভাগ সময় আকাশ থাকে মেঘে ঢাকা। ফলে সৌরশক্তিকে বছরের সব সময়ে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে না। যদিও সৌরশক্তি আমাদের বিদ্যুৎ ঘাটতি কমাবার সহায়ক হতে পারে। পারমাণবিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে ব্যয়বহুল। কেননা, উচ্চমূল্যে কিনতে হবে ইউরোনিয়াম এবং হেভি-ওয়াটার। এ ছাড়া পারমাণবিক বিস্ফরণ হতে পারে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের কারণ। আমাদের জন্য কয়লা অথবা পেট্রোলিয়াম জাতীয় তেল পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেক নিরাপদ ও সুলভ।
আমি বিদেশের সাথে যৌথ কোম্পানি গড়ার বিরোধী নই। চীন বিদেশের সাথে যৌথ কোম্পানি করে যথেষ্ট লাভবান হয়েছে। কিন্তু চীন এ রকম কোম্পানি গড়েছে যথেষ্ট ভাবনা চিন্তা করে। চীন কোম্পানি গড়েছে অর্থনীতির দিক থেকে যথেষ্ট অগ্রসর দেশের সাথে। ফলে সে উন্নত দেশের কাছ থেকে পেতে পেরেছে উন্নতকৃত কৌশল; কিন্তু ভারত এখনো সে রকম একটি উন্নত দেশ নয়। ভারতের তৈরি ডায়নামো ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি কতটা উন্নতমানের হবে এবং কত দিন টিকবে, তা আমরা বলতে পারি না। হয়তো দেখা যাবে কিছু দিন না যেতেই তা অকেজো হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক দিক থেকেও ভারতের সাথে যৌথ কোম্পানি এখনো করা নিরাপদ নয় বলে মনে হয়। রামপালের বৈদ্যুতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে তাই আন্দোলন করা যেতে পারে; কিন্তু সেটা করতে হবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যুক্তিতে; সুন্দরবনের যুক্তি তুলে নয়।
দৈনিক নয়াদিগন্ত/ ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৬।